‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই অমোঘ বাণী ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে কতটা বাস্তব তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি পুরুষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ৪৭ বছরের লড়াই সংগ্রামে বাঙালি জাতি যে তার আÍপরিচয় খুঁজে পেল, স্বাধীন পাসপোর্ট পেল আর তার অর্ধেকটাই জুড়ে ছিলেন তারই সহধর্মিণী বা অর্ধাঙ্গনী ঐ বেগম ফজিলাতুন নেছা। শুধু তাই নয়, শেখ সাহেব যে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তার পেছনেও বঙ্গমাতার অনন্য অবদান সর্বজনস্বীকৃত। লড়াই সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে কখনো দেশীয় কখনো বিদেশীয় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সঠিক পথের নির্দেশনা ও সাহস জোগাতেন এই মহিয়সী নারী। তার পথ ধরেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। বেগম মুজিব যদি বঙ্গবন্ধুর লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও অসহায়ত্বের বেড়া ভেঙ্গে সাহসী হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে না দাঁড়াতেন তবে বঙ্গবন্ধু বোধ করি এতটা পথ পাড়ি দিতে পারতেন না।
যশোর কো-অপারেটিভ ব্যাংকের ইন্সপেক্টর শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হকের দ্বিতীয় কন্যা ফজিলাতুন নেছার (রেনু) বয়স যখন দুই বছর তখন পিতৃবিয়োগ ঘটে। পরবর্তী সময়ে মা-ও চলে যান না ফেরার দেশে। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট এই মহিয়সী নারী জন্মেছিলেন। বিয়ের অর্থ না বুঝতেই মাত্র তিন বছর বয়সে মুরব্বিদের হুকুমে শেখ মুজিবের সঙ্গে বিবাহ হয় তার। যদিও ১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বৈবাহিক জীবনের যাত্রা শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের দুটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের সঙ্গে বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬৮ সালের পাক সরকারের দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তির পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওই রেনুই। তিনি কারাগারে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিষেধ করেছিলেন প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার জন্য। অথচ কোন নারী না চায় স্বামীকে কাছে পেতে? কিন্তু এই নারী সেই ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে দেশ দশের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। বঙ্গমাতা নিশ্চিত ছিলেন বাংলার মানুষের আন্দোলনে এক দিন তিনি মুক্তি পাবেন। যদিও তৎকালীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধুর প্যারোল মুক্তির পক্ষে ছিলেন। অবশেষে গণবিক্ষোভের মুখে পাক সরকার ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেরুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ১২ বছর কারাবাসের সময়ে সংসার, রাজনীতি, রাজনীতির অন্দরমহলের খবরাখবর রাখা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বঙ্গমাতার অবদান অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি কিন্তু তিনি ফার্স্ট লেডি হননি হয়েছেন বঙ্গমাতা। তিনি ছিলেন একাধারে এক জন মা, রাজনীতিক, কূটনীতিক এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নারী, যিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনের পরিপূরক ছিলেন। বঙ্গমাতার কারণেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ নির্ভার ছিলেন। নিজের বিবেক দিয়েই বিশ্বসেরা ভাষণে জাগ্রত করেছিলেন বাঙালি জাতিকে। তাও বঙ্গমাতার পরামর্শে। নেতাদের অনেক মতভিন্নতার মাঝে বঙ্গমাতা বলেছিলেন ‘তোমার বিবেক যা বলবে তুমি তাই বলবে’।
এই মহিয়সী নারী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই। ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যার পর ঘাতকের দল বঙ্গমাতাকে না মেরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন ‘আমি তোমাদের সাথে কোথাও যাব না’ ওকে যখন মেরেছে আমাকেও মার’ এমন কথা বলে বুক পেতে দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গমাতার জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মায়ের সম্পর্কে বলেছেন, বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন ত্যাগ-তিতিক্ষায় ভাস্বর ও সহিষ্ণুতায় অতুলনীয় সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রতীক।
(বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত)