রোববার, ০৪ জুন ২০২৩, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

তীব্র গ্যাস সংকটে নাকাল নারায়ণগঞ্জবাসী

আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:০০

‘খুব সকালে উঠে রান্না করা লাগে, মরার গেস সকালডা হইলেই মরা মরে। পোলাপানগুলারে নাস্তা বাইরে থেইক্যা কিন্না দেই। স্বামী সকালে খাওন খাইতে পারলেও দুপুরে ঠাণ্ডা খাবার খায়। রাইতে তো বাসি খাবারও খাইতে হয় মাঝে মইধ্যে।’ গ্যাস সংকট নিয়ে এমন অভিযোগ নগরীর গলাচিপা এলাকার গৃহবধূ আসমা বেগমের। তার মতোই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও আশপাশের বাসিন্দাদের একই অভিজ্ঞতা। 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বাবুরাইল, পাক্কারোড, দেওভোগ আখড়া, পালপাড়া, ভূইয়ারবাগ, নন্দীপাড়া, আমলাপাড়া, গলাচিপা, কলেজ রোড, জামতলা, উত্তর চাষাঢ়া, মাসদাইড়, মিশনপাড়া, খানপুর, মেট্টো হল, তল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাসের সংকট। এলাকাবাসীর অভিযোগ পূর্ণ বিল পরিশোধ করেও পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। 

শহরের পালপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছন্দা সাহা জানান, সকাল ৭টা বাজলেই নিভু নিভু গ্যাস থাকে। সাড়ে ৭টায় একদমই থাকে না। কোনো রকম খেয়ে দিন কাটলেও দুপুরের খাবার খাওয়া হয় বিকেল সাড়ে ৫টার পরে। তাই রান্নার কাজ সরতে হয় গভীর রাত কিংবা ভোর রাতে। ফলে নারীদের জন্য আলাদা ভোগান্তি তৈরি করেছে এই গ্যাস সংকট। এখন অনেক রান্নার জন্য তারা রাত জাগছে। আবার একবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে কয়েক বার সেই খাবার খাচ্ছে। এতে করে একদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অন্যদিকে বয়স্ক নারীদের নিত্য নতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।

আমলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ পপি রাণি সরকার বলেন, আজকে ১৫দিন যাবত আমাদের গ্যাসের তীব্র সংকটের মধ্যে আছি। আগে দুপুরে কিছুটা গ্যাস পাওয়া যেতো কিন্তু এখন সেটাও পাওয়া যায় না। ভোর ৪টা অথবা ৫টায় না উঠলে আমাদের বাসায় রান্নাই করা হয় না। বিকালে সাড়ে ৫টা পর কিছুটা গ্যাস থাকলেও সন্ধ্যার পর পর এটা একেবারেই কমে যায়। রাত ১১টার আগের গ্যাসের কোনো খোঁজ পাই না। ৩-৪ বছর আগেও আমরা একই ধরনের সংকট ভোগ করেছি। গ্যাস না থাকলেও আমাদের গ্যাসের বিল দিতে হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় এই গ্যাস কৃত্রিমভাবে দেওয়া, যাতে করে মানুষ সিলিন্ডার গ্যাসের দিকে চলে যায়। রাতে আমাদের ঘুমাতে ঘুমাতে সাড়ে ১২টা-১টা বেজে যায়। আমাদের আবার উঠতে হয় ভোর ৪টা-৫টায়। এতে করে শরীরে অতিরিক্ত চাপ পরে। এতে করে স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা করছে তিনি ও তার পরিবার। 

দেওভোগ পাক্কারোড এলাকার বাসিন্দা লিজা আক্তার বলেন, 'রাতে ঘুমাই দেরি করে, মাঝে মইধ্যে সকালে ঘুম থেইকা উঠতে পারি, আবার কখনো পারি না। আলাদা স্টপে (জ্বালানি তেলের চুলা) রান্না করতে হয় আমাগো। এখন বাজারে যে হারে জিনিসপত্র আর কেরোসিন তেলের দাম বাড়ছে, এতে আমাগো ডবল টাকা খরচ হইতাছে। গ্যাস না থাকায় কেরোসিন দিয়েই রান্না করতে হয়। আবার তরকারির দামও বেশি। কই যামু আমরা কন।'

নারায়ণগঞ্জ একটি ব্যস্ততম শহর। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার মানুষের বসবাস এই জেলায়। 

গ্যাসের সমস্যা প্রভাব শুধু পরিবারগুলোর মধ্যেই না, সেইসঙ্গে পড়েছে ব্যাচেলরদের ওপরেও। দূর দুরান্ত থেকে নারায়ণগঞ্জে আসা শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের জীবনেও তৈরি হয়েছে ভোগান্তি। গ্যাসের সংকটের কারণে সময়মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যেতে পারছে না তারা। বন্দর এলাকায় ব্যাচেলর শিক্ষার্থী মন্ময় সাকিব জানান, ৩ বেলা খাবার মাসিক চুক্তিতে খাই পাশের বাসায় এক আন্টির কাছে। কিন্তু গ্যাসের সংকটের কারণে ৩ বেলার জায়গায় ২ বেলা খাবার পাই। আজকেও সকাল থেকে না খেয়ে আছি। তার ওপর দুপুরের খাবার পাই বিকালে আর রাতের খাবার পাই ১২টা পরে। কলেজ রোড এলাকায় ব্যাচেলর থাকা মোহাম্মদ আল মেহেদী জানান, আমার পরিবার ঢাকার মিরপুরে থাকে। আমি নারায়ণগঞ্জে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি। গ্যাস না থাকায় প্রতিদিন সকালে না খেয়েই বাসা থেকে বের হই। দুপুরের খাবার বিকালে খাই। রাতে দেড়টার আগে কোন ভাবেই খাবার খাওয়া যায় না। 

গ্যাসের তীব্র সংকটের কথা জিজ্ঞাসা করলে নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাসের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌ. মো. মামুনার রশিদ জানান, বর্তমানে আমাদের যে পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা, সে পরিমাণ গ্যাসের সাপ্লাই আমরা দিতে পারছি না। সাময়িকভাবে এমন গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন। যদি এটা চালু হয়ে যায় তাহলে গ্যাস চালিত যে পাওয়ার প্লান্ট আছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এতে গ্যাস সংকট কিছুটা কমবে। আর আমাদের এই সংকটটা যে শুধু নারায়ণগঞ্জে, তা কিন্তু নয়। এটা সারাদেশেই চলছে। 

তিনি আরও বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে মানুষের কাছে আমার আহ্বান, আপনারা একটু ধৈর্য ধারণ করুন, আপনারা সরকারকে একটু সহায়তা করুন। আশা করি আমরা খুব শিগগিরই এই সংকট কাটিয়ে উঠবো।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. গোলাম মোস্তফা জানান, রাতে কম ঘুমানোর কারণে অবশ্যই স্বাস্থ্যর মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ঘুম যদি আমাদের কম হয় তাহলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। যাদের হাইপার টেনশন ও ডায়বেটিকসের মতো সমস্যা আছে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। আর যারা সুস্থ আছে তারাও অসুস্থ হয়ে পড়বে। 

তিনি আরও বলেন, যদিও এখন নারীদের ক্ষেত্রে এটা খুব একটা সমস্যা। তাই আমাদের পরামর্শ থাকবে সকালে নাস্তা খাওয়ার পর ঘুমিয়ে সেটি পুশিয়ে নেওয়া সম্ভব। যে কোন মানুষের ৬ থেকে ৮ঘণ্টা ঘুম খ্বুব প্রয়োজন। কোন মানুষের ৬ ঘণ্টায় পুষিয়ে যায়, আবার কারো ৮ঘন্টা লাগে। তাই আমরা বলবো আপনার যখন ক্লান্তি লাগবে, তখনই আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি