আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদ বাড়ছে জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। দলের প্রতিষ্ঠাতা এইচএম এরশাদের জীবদ্দশায়ও সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কয়েকবার বিভক্তির কবলে পড়েছিল দলটি। এরশাদের মৃত্যুর পর আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ বিবাদের ঘোরে পড়তে যাচ্ছেন তার সহোদার ও জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। দলের সাবেক কয়েক নেতা একত্র হয়ে রওশন এরশাদকে সামনে রেখে ‘কাদেরবিরোধী’ ঢেউ তোলার চেষ্টা করছেন দলটিতে। ফলে এক ধরনের ঘরোয়া উত্তাপ চলছে জাপায়। সম্প্রতি নতুন করে বিবাদের সূত্রপাত ঘটে এরশাদপত্নী, জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রওশন গত ৩১ আগস্ট নিজের স্বাক্ষরিত ঐ চিঠিতে জাপার কাউন্সিলের ঘোষণা দেন। দলের কাউন্সিলের সময়সীমা অতিক্রান্ত না হলেও আগামী ২৬ নভেম্বর দশম কাউন্সিল ডেকেছেন তিনি।
এই চিঠির পরদিনই জাপার পার্লামেন্টারি পার্টি বৈঠক করে তার পরিবর্তে জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছে।
‘দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না’- এমন কারণ দেখিয়ে তার পরিবর্তে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকারকে গত ১ সেপ্টেম্বর চিঠি দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার আগে ওইদিন দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত সংসদ ভবনে জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক হয়। বৈঠকে জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর জাপার প্রেসিডিয়ামের বৈঠকেও জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মনোনীত করা হয়।
এবিষয়ে জিএম কাদের গতকাল শনিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা স্পিকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। স্পিকার বর্তমানে দেশের বাইরে। আমাদের দলের পার্লামেন্টারি পার্টি বৈঠক করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছে। পরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের শতভাগও আমাকে বিরোধীদলীয় নেতা করার বিষয়ে সমর্থন দিয়েছে। কাজেই এখানে স্পিকারের আমলে না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরেও দেখি স্পিকার কী করেন, আমরা অপেক্ষা করছি।’
উজবেকিস্তানের তাসখন্দে উইমেন স্পিকার্স অব পার্লামেন্টের ১৪তম সামিটে যোগ দিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তান গেছেন সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। আজ রবিবার তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে দেশের সংবিধানে কিছু বলা নেই। এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখিতয়ার স্পিকারের। সংসদের কর্যপ্রণালী বিধির ২(১)(ট)- তে বলা বলা হয়েছে, “ ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা”।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পরও বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া নিয়ে স্পিকারকে পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। শেষ পর্যন্ত দলের ভেতরে সমঝোতায় রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হন।
আগামী ২৬ নভেম্বর রওশন জাপার যে কাউন্সিল ডেকেছেন সেটির প্রস্তুতি ক?মি?টির আহ্বায়ক হয়েছেন রওশন নিজেই। আর সদস্য সচিব করেছেন তার রাজনৈতিক সচিব ও সৌদিআরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহকে। রওশনের ঐ চিঠির বিষয়ে গোলাম মসিহ ইত্তেফাককে বলেন, ‘চিঠিটি সত্য ও সঠিক। ম্যাডাম নিজেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।’ তবে এবিষয়ে রওশনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, জাপার সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান ও বর্তমানে পদবঞ্চিত নেতা অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু স্বাক্ষরিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে গতকাল। এতে দাবি করা হয় যে, রওশন বলেছেন, ‘আমি পুরোপুরি সুস্থ, আমার উপর কোনো ধরনের চাপ নেই। যারা আমাকে বারবার অসুস্থ বলে প্রচার করছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
তবে রওশনকে উদ্ধৃত করে পাঠানো এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এবং কাউন্সিল আহ্বান করে পাঠানো আগের চিঠির বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সত্যতা মেলেনি। বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রওশনকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তার মোবাইলে পাঠানো এই প্রতিবেদকের বার্তা তিনি দেখলেও এর সত্যতা সম্পর্কে কিছু জানাননি। ফলে রওশনের এই দুটি চিঠির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জাপার নেতা-কর্মীদেরও ধারণা, এই দুটি চিঠির বিষয়ে রওশন আদৌ কিছু জানেন কিনা- সেই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
তবে বর্তমানে রওশনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এবং জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘দুটো চিঠিই ম্যাডামের।’ তবে বিষয়টি এই প্রতিবেদকের কাছে তিনি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। মামুন জানান, এমাসের শেষদিকে রওশন এরশাদ দেশে ফিরবেন, এরপর সংসদের পরবর্তী অধিবেশনেও যোগ দেবেন।
জিএম কাদেরকে কবর ও বড়ই পাতার গরম পানির ছবি পাঠিয়েছেন কাজী মামুন, থানায় জিডি
কাজী মামুনুর রশীদ গত ৫ আগস্ট জিএম কাদেরকে তার মোবাইলে ‘জীবননাশের হুমকিসংবলিত’ বার্তা পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কাজী মামুনের মোবাইল থেকেই জিএম কাদেরের মোবাইলে বরইগাছের পাতা দিয়ে পানি গরম করা হচ্ছে- এমন ভিডিওচিত্র পাঠানো হয়। এরপর কাজী মামুন একটি কবরের ছবিও পাঠান জিএম কাদেরকে। এ ঘটনায় গত ৭ আগস্ট জিএম কাদেরের জীবননাশের হুমকির কথা জানিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বিরোধীদলীয় উপনেতার সহকারী একান্ত সচিব অ্যাডভোকেট মো. আবু তৈয়ব।
এবিষয়ে কাজী মামুন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এখানে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ, প্রত্যেকেরই কবরের কথা স্মরণ করা উচিত, কবরকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। প্রত্যেক নামাজের পর কবরের কথা মনে করা উচিত। তাছাড়া আমি শুধু জিএম কাদের সাহেবকেই নয়, জাপা নেতা এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ আমার পছন্দের আরো অনেককেই এটা ফরোয়ার্ড করেছি। গোলাম মসিহকেও পাঠিয়েছি।’