ছোটবেলায় দুপুরের কিংবা রাতের খাবারের পর মা এবং দাদিরা আমাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মনগড়া রাজা-রানির গল্প শোনাতেন। আমাদের শিশু মন হয়তো রূপকথার রাজা এবং রানির সাম্রাজ্যের ছবি এঁকে ফেলত। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হই তখন জানতে পারি—রূপকথা নয়, বাস্তবেই সুদূর ব্রিটেনেই রাজা-রানির বাস। রাজাকে দেখা সম্ভব না হলেও রানিকে আমরা দূর থেকে সামান্য দেখতে পেয়েছি। বাংলাদেশ সফরের সময় কেউ কেউ সরাসরি। তার জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পেরেছি। রূপকথার মতো শোনা গেলেও বাস্তবে সেই মহীয়সী নারী তথা কর্তব্যপরায়ণ নারীর নাম রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
দ্বিতীয় এলিজাবেথের রানি হওয়াটাও ছিল স্বপ্নের মতো। রাজ পরিবারের সদস্যদের পছন্দের ছুটি কাটানোর জায়গা সুদূর আফ্রিকার কেনিয়া। বিয়ের পরপরই স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে কেনিয়ার একটি জঙ্গলে বন্যপ্রাণী দেখতে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের যুবরানি। হঠাত্ ঘুম থেকে উঠে শুনলেন মারা গেছেন তার বাবা ষষ্ঠ জর্জ। সেই থেকেই ইংল্যান্ডের রাজকীয় ইতিহাসের ধারায় যুক্ত হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়। তবে কথায় আছে, ‘যার আদি আছে, তার অন্তও নিশ্চিত’। শেষ হয়েছে সেই অধ্যায়। ইতি ঘটেছে এক সত্যিকারের রানির রূপকথার গল্পের। ৯৬ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন দীর্ঘ ৭০ বছর ইংল্যান্ডের মসনদে থাকা রানি। দীর্ঘ জীবনে সাক্ষী থেকেছেন ইংল্যান্ডের বেশকিছু নজিরবিহীন ঘটনার। চার্লস-ডায়নার বিচ্ছেদ, ডায়নার অস্বাভাবিক মৃত্যু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যা, বার্লিনের প্রাচীর ভাঙা, চাঁদে মানুষের পা, করোনা মহামারিসহ অনেক কিছুর।
- জীবনটা যেন রূপকথার মতো
১৯৫৩ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রানির মুকুট পরতে হয় এলিজাবেথকে। এরপর থেকে দীর্ঘদিন নিজের কর্তব্য সামলে এসেছেন মহারানি। দিন যত গড়িয়েছে ব্রিটেনের জনপ্রিয়তা কমেছে। রাজপরিবারের অনেককে নিয়ে বিতর্কের কথা শোনা গেলেও রানির জনপ্রিয়তায় সামান্যতম আঘাত আসেনি। রানি সব বিতর্ককে সামাল দিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনযাপন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। কারণ রাজপ্রাসাদে ক্যামেরা কখনো প্রবেশ করতে পারেনি। এক বার ক্যামেরা প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদে সদস্যদের খেলাধুলার ছবি প্রকাশ হয়েছিল। এতে রানি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ তিনি চাননি রাজপরিবারের সদস্যদের জীবনযাপন বাইরের মানুষ জানুক। তবে একেবারে ঢেকে রাখাও সম্ভব হয়নি। কারণ রাজপরিবারের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীই বাইরে আসার পর বই লিখে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমে তাদের জীবন কাহিনি কিছুটা হলেও প্রকাশ করেছেন।
রানির ব্যক্তিগত সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি ডলার। বিনিয়োগ, শিল্প সংগ্রহ, গয়না এবং রিয়েল এস্টেট থেকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করেছেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। মায়ের কাছে থেকে ৭ কোটি ডলার মূল্যের পারিবারিক সম্পত্তিও পেয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে দামি পেইন্টিং, গয়না, স্ট্যাম্প সংগ্রহ, ঘোড়া ইত্যাদি। ফোর্বস ম্যাগাজিন জানিয়েছে, রানির ঐতিহাসিক ফুলদানি এবং অপরিবর্তনীয় পেইন্টিংগুলো পালিশ করার জন্য বছরে ১০ হাজার ৫০০ ডলার ব্যয় হতো। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে বলা হতো ফ্যাশন আইকন। জীবনভর নানা রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতায় মাথার মুকুট থেকে শুরু করে দুর্দান্ত সব নকশার অলংকারে সাজতেন তিনি। সেসবের মধ্যে রয়েছে ৩০০ হীরার সূক্ষ্ম কাজের বড়সরো একটি হার যা তিনি ভারত থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। মার্কিন মিডিয়া সিএনএন জানিয়েছে, রানির ফ্যাশন হয়তো আরো বহু বছর ধরে ব্রিটিশদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাবে। রানির ব্যবহূত গয়নাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ সময় লক্ষণীয় ছিল হীরার মুকুট আর ছোট্ট কানের দুল। রানির সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি পরিহিত টায়রা ছিল তার দাদি কুইন মেরির কাছ থেকে বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া চকচকে হীরার টায়রা। দ্য ‘ভ্লাদিমির টায়রা’ ছিল রানির আরেকটি প্রিয় টায়রা। রাশিয়া থেকে পাচার করা হয়েছিল এটি। হীরার সঙ্গে সঙ্গে এই টায়রাটিতে রয়েছে মুক্তা আর দামি পান্না। আইকনিক ট্রিপল-স্ট্র্যান্ড মুক্তার নেকলেস এবং মানানসই স্টাড কানের দুল তার প্রিয় সঙ্গী ছিল। রয়্যাল কালেকশন ট্রাস্ট অনুসারে, ১৮২০ সালে চতুর্থ জর্জের রাজ্যাভিষেকের জন্য তৈরি করা অত্যাশ্চর্য মুকুটে ১ হাজার ৩৩৩টি হীরা এবং ১৬৯টি মুক্তা রয়েছে। মুকুটের নকশায় ইউনাইটেডের প্রতীকের সঙ্গে শোভা পেয়েছে গোলাপ, শ্যামরক ও থিসলস। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য রাজকীয় অনুষ্ঠানে, এমনকি তার রাজ্যাভিষেক দিবসে এবং পার্লামেন্টের রাষ্ট্রীয় উদ্বোধনীতেও মুকুটটি পরিধান করেছেন। ১৯০৫ সালে আবিষ্কৃত বিখ্যাত কুলিনান ডায়মন্ড থেকে নেওয়া ‘ছোট’ তৃতীয় এবং চতুর্থ পাথরের তৈরি বিশালাকৃতির ব্রোচটি রানির সবচেয়ে বেশি প্রিয়। রানির সবচেয়ে দামি গয়নাগুলোর মধ্যে একটি ছিল প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে বিয়ের উপহার পাওয়া ঝকঝকে হীরার ব্রেসলেট যা ‘দ্য এডিনবার্গ ওয়েডিং ব্রেসলেট’ হিসেবে পরিচিত। রানির ব্যবহূত গয়নাগুলোর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক অংশ ছিল এক জোড়া মুক্তার কানের দুল, যা আগে এক বার রানি ভিক্টোরিয়ার মালিকানাধীন ছিল। এটা ‘রানি ভিক্টোরিয়ার পার্ল ড্রপ কানের দুল’ নামে পরিচিত।
ব্রিটেন জুড়ে রাজপরিবারের প্রাসাদ এবং লজ মিলিয়ে ৩০টি বাড়ি আছে। লন্ডনে রানির সরকারি বাড়ির নাম বাকিংহাম প্রাসাদ। সাধারণত সপ্তাহান্তে তিনি কাটান বার্কশায়ারে উইন্ডসর ক্যাসেলে। আর ঈস্টারের সময় পুরো এক মাস কাটান। রানির গ্রীষ্মকালীন বাসভবন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদ। ম্যাককার্থি স্টোনের সমীক্ষা অনুসারে, বাকিংহাম প্যালেসে ৭৭৫টি কক্ষ রয়েছে। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি বাড়ি বলে মনে করা হয়। এর আনুমানিক মূল্য ১০৩ কোটি ডলার। মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার জানিয়েছে, রানির জন্য প্রাসাদে ১ হাজার ১৩৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্বে ছিলেন। যদিও এই সংখ্যা নিশ্চিত নয়। এর চেয়ে বেশি হতে পারে। তারা কেবল রানির কাজগুলোই করেন। বিজনেস ইনসাইডার জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে এদের বেতন, পারিশ্রমিক এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়েছিল ৪৮২ কোটি ৩২ লাখ টাকা (৪৪ দশমিক এক মিলিয়ন পাউন্ড)।
- সরকার থেকেই পান কোটি কোটি টাকা
প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী প্রিন্সেস মেগান মার্কেল গত মার্চে অপরাহ উইনফ্রেকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে জানান, ব্রিটিশ রাজপরিবার যেন একটা ফার্ম। রাজা জর্জ তৃতীয় এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। ঐ চুক্তি অনুযায়ী, রাজা জর্জ তার সমস্ত সম্পত্তি পার্লামেন্টকে দেন। বিনিময়ে রাজপরিবারকে ব্রিটিশ সরকার প্রতি বছর একটা থোক বরাদ্দ দেয়। একে আগে ‘নাগরিক তালিকা’ বলা হলেও ২০১২ সাল থেকে ‘সার্বভৌম অনুদান’ হিসেবে পরিচিতি পায়। চুক্তি অনুযায়ী, করদাতাদের তহবিল থেকে সার্বভৌম অনুদানের আকারে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পেতেন রানি। ২০২১-২২ সালে রাজপরিবারকে অনুদানের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৯৫ কোটি টাকা (৮৬ মিলিয়ন পাউন্ড)। রানির প্রাসাদ বাকিংহামের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই টাকা রাজপরিবারকে দেওয়া হয়। রানিকে আলাদা করে কোনো টাকা বা বার্ষিক অনুদান দেওয়া হয় না। ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, ২০২১ সাল নাগাদ রাজপরিবারের রিয়েল এস্টেটের সম্পদ ছিল প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ব্রিটেনের রয়্যাল ফার্ম ‘মনার্ক পিএলসি’ নামে পরিচিত। যদিও ক্রাউন এস্টেট মারফত জমি এবং অন্যান্য হোল্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর বিশাল তহবিল আসে, তবে এটি রানি বা অন্য কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ক্রাউন এস্টেট আধা-স্বাধীন পাবলিক বোর্ড দ্বারা পরিচালিত। ২০২১-২২ এর জুনে ক্রাউন এস্টেট থেকে প্রায় ৩২ কোটি ডলারের রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার বেশি। প্রকৃতপক্ষে, সার্বভৌম অনুদানের আকারে যা দেওয়া হয় তা এই রাজস্বের অংশ, যা শুরুতে ১৫ শতাংশ ছিল। ২০১৭-১৮ সালে তা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এখন ২০২৮ সালের মধ্যে ফের তা ১৫ শতাংশে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
- দুর্নাম তাকে ছুঁতে পারেনি
ঝড়ের মেঘ কেটে গেছে। আরো কিছু তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা এসেছে এবং গেছে। বিবিসির সাবেক রয়্যাল করেসপন্ডেন্ট পিটার হান্ট জানান, আমরা সবাই রানির বাইরের জীবন সম্পর্কে জানি। তার বন্ধুরা বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে প্রাসাদের ভেতরে তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী এবং তার রসবোধ ছিল। তিনি ছিলেন এমন এক নারী যাকে দেখে সমীহ জাগতো এবং একই সঙ্গে তার হাসির মাধ্যমে দ্যুতি ছড়াতেপারতেন। তার সমালোচনাকারীরা মনে করতেন, তিনি ছিলেন নাগালের বাইরে এবং তার কাছে যাওয়া যেত না। কিন্তু তার অগণিত ভক্তরা বলেন, তিনি কখনো জনগণের শ্রদ্ধা হারাননি। উইন্ডসর ক্যাসেলের অন্য সদস্যদের যেভাবে কেলেঙ্কারি স্পর্শ করেছে সেটি রানির ক্ষেত্রে হয়নি। জীবনভর তার একাকী দায়িত্বে খ্রিষ্টান ধর্ম এবং তার স্বামী সমর্থন জুগিয়েছেন। পিটার হান্ট মনে করেন, উইন্ডসর হাউজ এখন তার ছেলের হাতে, যার মেয়াদ তার মায়ের চেয়ে সংক্ষিপ্ত হবে। এখন সুযোগ এসেছে একজন দীর্ঘজীবী এবং লাজুক রানি, যিনি জনগণের ভালোবাসা পেয়েছেন, তার জীবনের প্রতি আলোকপাত করার।