একসময় বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। কালের পরিক্রমায় সেখানেও অস্ত যাওয়া শুরু হলো। উপনিবেশগুলো একের পর এক তাদের হাতছাড়া হলো। বিশাল সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার বিষয়টি ব্রিটিশ জনমানসের মনস্তত্বের ওপরও প্রভাব ফেলে। সদ্যপ্রয়াত রানি এলিজাবেথ এমনই একসময় দেশটির সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। উপনিবেশ পরবর্তী ব্রিটেনের একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তার মধ্য দিয়েই যেন বিকশিত হয়। সাতটি দশক ধরে তিনি ছিলেন দেশটির ঐক্যের প্রতীক। এই সময়ে দেশে-বিদেশে বহু দুর্ঘটনার সাক্ষী তিনি। বিশ্বে এই কয়েক দশকে যে পরিবর্তন হয়েছে এর আগে অনেক শতাব্দীতেও এতটা পরিবর্তন আসেনি। তিনি ছিলেন বিক্ষুব্ধ সময়ে সকলের আস্থার জায়গা।
রানি এলিজাবেথ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তার প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায়নি। তিনি ছিলেন ঘটনাবহুল অতীত এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বর্তমানের মধ্যে একটি যোগসূত্র। ১৯২৬ সালে যখন জন্মগ্রহণ করেন তার পিতামহ পঞ্চম জর্জ তখন বিশ্বের এক চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠীর রাজা ছিলেন। আর ২০২২ সালে যখন তিনি মারা যান তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই যুক্তরাজ্য নাই। বহির্বিশ্বে দেশটির অবস্থান এতটাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।
ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের মধ্যে দ্বিতীয় এলিজাবেথই সবচেয়ে বেশি দিন সিংহাসনে ছিলেন। এর আগে রানি ভিক্টোরিয়ার রেকর্ডটি ছিল। এলিজাবেথের সময় যুক্তরাজ্য অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দেয়। এলিজাবেথ জীবদ্দশায় তার দেশকে সাতটি যুদ্ধে জড়াতে দেখেছেন। দেখেছেন সোশ্যালিস্টদের ক্ষমতায় যেতে, আকাশ ছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, ধবংসাত্মক ধর্মঘট, প্রাণঘাতী মহামারি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন এবং ইইউ থেকে ছিটকে পড়া। অ্যান্টনি ইডেন থেকে লিজ ট্রাস পর্যন্ত ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। একই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ জন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার হাত বদল দেখেছেন। তিনি যখন সিংহাসনে আসীন হন তখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল। তিনি ১৮৯৮ সালে আফ্রিকায় সুদানের বিরুদ্ধে ব্যাটল অব ওমদুরমানে অংশগ্রহণকারী একজন যোদ্ধা ছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের জন্মই তখন হয়নি। এলিজাবেথ পূর্ব যুক্তরাজ্য বা তার সিংহাসনে আরোহণের প্রথম কয়েক দশকের স্মৃতি ব্রিটিশদের মানসপট থেকে বলতে গেলে হারিয়ে গেছে।
যদিও দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি যুগকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু এই সময়ে ব্রিটেনের একটি পরিচয় তুলে ধরতে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের শেষের দিকে যখন বাইরের কর্মকাণ্ডে তাকে খুব একটা দেখা যেত না তখনও তার প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ৭০ শতাংশের মতো ছিল। পশ্চিমা কোনো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরও যা ছিল না। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন শনিবার মন্তব্য করেছেন, নতুন রাজা চার্লস স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আকার ছোট করে আনবেন বলে তিনি আশা করেন। তবে রাজতন্ত্রের অবসান তিনি চাননি। এলিজাবেথের জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ ছিল রাজনৈতিক ইস্যু থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রাখা। প্রশ্ন হতে পারে চার্লস কি পারবেন উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে। স্থাপত্যকলা এবং পরিবেশ তার পছন্দের বিষয়। তিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক সময় খোলামেলাভাবে তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। এই মন্তব্য অনেক সময় বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। যেমন ব্রেক্সিট ইস্যুতে প্রয়াত রানির কিছু ব্যক্তিগত মতামত ছিল। তিনি কখনো সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি। চার্লস এ বিষয়ে কতদূর স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারবেন সেটা সময়ই বলে দেবে। লেবার পার্টির বামপন্থি স্পষ্টভাষী নেতা জেরেমি করবিন ২০১৬ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে রানির প্রশংসা করে দেশের প্রতি তার অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি রাজতন্ত্র বিরোধী হিসেবে পরিচিত তা সত্ত্বেও ঐক্যের প্রতীক রানিকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি বিবেচনা করতেন।
এলিজাবেথ সবচেয়ে বেশি দেশ সফর করা ব্রিটিশ রাজন্য। তিনি ১৯৬১ ও ৮৩ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। ৬৩ বছরে ১৩২টি দেশে তিনি ২৭০ বার সফর করেন। ভিক্টোরিয়া ইউরোপের বাইরে কোনো দেশ সফর করেননি। এলিজাবেথ যেমন বার্লিন প্রাচীন তৈরি ও এর সম্প্রসারণ দেখেছেন তেমনি দেখেছেন প্রাচীরটির পতন। ব্রিটেন একসময় বিশ্বের এক বড় অংশ শাসন করেছে। কমনওয়েলথের মাধ্যমে সাবেক শাসিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেন।