ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন সাত মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। এই যুদ্ধের শুরু থেকেই যে দেশটি দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতায় সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে, সেটি নিঃসন্দেহে তুরস্ক। সে কথা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও স্বীকার করেছেন। উজবেকিস্তানের সমরখন্দে সদ্যসমাপ্ত সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজেশনের শীর্ষ সম্মেলনের শেষদিনে পুতিন বলেন, তুরস্ক এই যুদ্ধ বন্ধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেন আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে প্রস্তুত নয়। এই তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে খাদ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়েছে। যার আওতায় ইউক্রেন তাদের খাদ্যশস্য বিভিন্ন দেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কের বেশি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে। কিন্তু প্রকৃপক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে তুরস্কের বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ রয়েছে। সম্প্রতি আলজাজিরার এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্ষতিতে তুরস্কই লাভবান হচ্ছে। দেশটি তাদের প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে।
গত মাসে ক্রিমিয়া বিষয়ক সম্মেলনে এক ভিডিও বক্তৃতায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ইউক্রেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে ফেরা জরুরি। যারা তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা নিশ্চয়ই এরদোয়ানের এ বক্তব্যে খুব একটা বিস্মিত হননি। একদিকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের জন্য এরদোয়ান সমর্থন দিচ্ছেন, অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ বিপরীতমুখী অবস্থানের উদাহরণ তার ওই বক্তব্য। ক্রেমলিন যখন ইউক্রেনে ধুঁকছে, তখন আঙ্কারা নিজেদের মতো হিসাব কষছে। সিরিয়া হোক কিংবা দক্ষিণ ককেশাস; যেখানেই আপাতদৃষ্টিতে রশিয়ার প্রভাব কমছে, সেখানেই তুরস্ক শূন্যস্থান পূরণে প্রস্তুত হচ্ছে।
এরদোয়ান এখনও ক্রিমিয়া বিষয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছেন। কারণ ক্রিমিয়ার তাতারদের বাস এই ক্রিমিয়াতে। এই তাতাররা তুরস্ককে আত্মীয় রাষ্ট্র বলেই মনে করে। ইউক্রেনে তুরস্কের সামরিক সমর্থনের প্রমাণ হলো—আঙ্কারা ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীকে বেয়রাকটার ড্রোন সরবরাহ করেছে।
২০০৮ সালে জর্জিয়া যুদ্ধের পর কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধিকে তুরস্ক হুমকি হিসেবে দেখছে। পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি গভীর অনাস্থার মুখে আঙ্কারার নিজস্ব দুর্বলতার অনুভূতি এটিকে মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তার বিশাল সাম্রাজ্যবাদী-মনস্ক প্রতিবেশীর সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য করেছে। একই সময়ে তুরস্ক ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, রোমানিয়া এবং মলদোভার মতো অন্যান্য কৃষ্ণসাগরের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যারা রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী নীতির ব্যাপারে ভীত। বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্ক আরো এক ধাপ এগোতে চাইছে। যেমন, উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের পদক্ষেপ। গত মে মাস থেকে এরদোয়ান তাল রিফাত ও মানবিজ এলাকা থেকে পিপলস প্রটেকশন ইউনিট বা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি সমর্থিত ওয়াইপিজিকে সরাতে আক্রমণ পরিচালনার কথা বলে আসছেন। এজন্য এরদোয়ান রাশিয়া ও ইরানকে কাছে পেতে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
দক্ষিণ ককেশাসেও রাশিয়ার লোকসানের মাধ্যমে তুরস্ক এগোতে চাইছে। গত জুলাইতে তুরস্ক ও আর্মেনিয়া নব্বইয়ের দশকের পর সীমান্ত খুলে দেওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার কূটনীতিকরা সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে আলোচনা করছেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে আজারবাইজান যখন তুরস্কের সহায়তায় নাগারনো-কারাবাখে আর্মেনীয়দের পরাস্ত করে, তখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভেস্তে যায়। রাশিয়া সেখানে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে এবং আর্মেনীয় সেনারা নিজেরাই লড়াই করে। এখন আর্মেনীয় নেতৃত্ব বাস্তবতা অনুধাবন করে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের পথ উন্মোচন করছে।
অবশ্যই রাশিয়া চাইলেই তুরস্কের এসব প্রচেষ্টা থামিয়ে দিতে পারে। কারণ রাশিয়ার এখনো ইরান এবং সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সংঘাত যে নাগারনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে, সেখানে রাশিয়া ২ হাজার শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েন করেছে। সংঘাতের ক্ষেত্রে সেখানে এই সেনারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আর্মেনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে রাশিয়ার অর্থনৈতিক লাভও রয়েছে। তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে। কারণ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আর্মেনিয়া এখন রাশিয়ার পেছনের দরজা হিসেবে কাজ করছে।
যারা এখনো মনে করেন, ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধু রাশিয়া, ইউক্রেন এবং পশ্চিমাদের মধ্যকার যুদ্ধ তাহলে তাদের আরো একটু গভীরভাবে দেখতে হবে। এখন ইউক্রেনে বিপর্যস্ত রাশিয়া যদি তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা বন্ধ করে, তাহলে অন্য দেশ সেখানে তাদের কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।