ওরা অদম্য, ওরা সাহসী। হিমালয়ের দেশে গিয়ে হিমালয়সম সাহস দেখিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার রানির মুকুট ছিনিয়ে এনেছে ওরা।
ঝিমিয়ে পড়া বাংলার ফুটবলে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে ওরা। হ্যা, আপনি ঠিকই ধরেছেন। বলছি সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কথা।
গল্পটা শুধু একটা ফুটবল দলের না, গুটিকয়েক কিশোরীর অদম্য সাহসের গল্প। যেই সাহসে ভর করেই ওরা পেরিয়েছে শত প্রতিকূলতা, শত বাঁধার দেয়াল।
সাবিনা-সানজিদাদের গল্পটা আপনাদের কম বেশি সবারই জানা। হাটি হাটি পা পা করে চলতে শুরু করা এই মেয়েরাই লাল সবুজের ফুটবলে এনেছে নতুন ভোর। ১৯ বছরের অপেক্ষা পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তুলেছে বাংলাদেশে।
২০০৩ এর ছেলেদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর গুনে গুনে পেরিয়ে গেছে ১৯টি বছর, এই উপমহাদেশের সেরার তকমাটা আর গায়ে জড়ানো হয়নি বাংলাদেশের। অবশেষে সাবিনাদের হাত ধরেই হয়েছে অপেক্ষার অবসান।
২০১৬ তে শিলিগুড়ির সাফে স্বাগতিক ভারতের কাছে ৩-১ গোলের পরাজয়ে স্বপ্নভঙ্গ। দমে যাননি বাংলার বাঘিনীরা। বাধার দেয়াল ডিঙিয়েই অবশেষে করেছে স্বপ্নপূরন। কাকতালীয় কিনা বলতেই পারেন, শিলিগুড়ির সেই ৩-১ গোলের হারে স্বপ্নভঙ্গ, কাঠমুন্ডুতে এসে ধরা দিয়েছে ৩-১ গোলের স্বপ্নপূরণ হয়ে।
শুধু ফাইনালের স্কোরলাইনও হয়তো আপনাকে বোঝাতে পারবে না ওদের দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের গল্পটা। দেশ থেকে কাঠমুন্ডু রওনা হওয়ার আগেই ওরা জানিয়ে গিয়েছিলো স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যের কথা। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বা গুরু গোলাম রব্বানী ছোটন, সবার কন্ঠেই ছিলো স্বপ্নকে সত্যি করে দেশে ফেরার প্রত্যয়। ওরা পেরেছে, নিজেদের অদম্য সাহসে ভর করে ওরা যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে তেমন সেই স্বপ্নপূরণও করেছে।
ফাইনালের আগে মিডফিল্ডার সানজিদা আখতারের ফেসবুকে করা আত্মপ্রত্যয়ী পোস্টেও দেখা গেছে স্বপ্নপূরণের দৃঢ়তা। সানজিদা লেখেন 'যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থণের প্রতিদান আমরা দিতে চাই।'
অবশেষে নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান সানজিদারা ঠিকই দিয়েছেন। অধরা সাফের শিরোপা এনে দেশকে ভাসিয়েছেন আনন্দের উল্লাসে।
সাফের প্রথম পাঁচ আসরেই চ্যাম্পিয়ন দলের নাম ছিলো ভারত। এবার তারা উঠতে পারেনি ফাইনালেই। সাফের নতুন চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাসে নাম লেখানোর সুযোগ ছিলো দুই দলের সামনেই। সেই লড়াইয়ে বাংলাদেশের কাছে হার মেনেছে নেপাল। ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে সাবিনারা। তবে ইতিহাসের হাতছানি যেমন তেমন, বাংলার মেয়েদের শত বাঁধা ডিঙানো মনোবলের কাছেই যেন হারতে হয়েছে হিমালয় কণ্যাদের।
কলসিন্দুরের সেই ছোট্ট গ্রাম থেকেই যে গল্পের শুরু, সেখান থেকে আজকের সাফের রানি। দীর্ঘ এই পথটা পাড়ি দিতে নিজেদের জীবনে সংগ্রামের একেকটি অধ্যায় নতুন করে লিখেছেন বাংলার মেয়েরা। সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে বাঁধা পেতে পেতে ইচ্ছে হয়েছে হাল ছেড়ে দিতে। আবার ঠিক তখনই যেন মনে হয়েছে, থেমে গেলে চলবে না। বাংলার ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো ঘাড়ের রগটা বাঁকা করেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে, ঘুরে দাঁড়িয়েছেও তারা।
নিজেদের জন্য না হোক, অন্তত পরের প্রজন্মের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা আরেকটু সহজ করে দিতেই যেন এই সানজিদাদের যত প্রচেষ্টা, 'ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনী কে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।'
নিজেদের জন্য কোনো প্রাপ্তি চাননি এই মেয়েরা। চেয়েছে লাল সবুজটার এই দেশটার জন্যই। পেরেছে তারা, শত প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়েও প্রমান করেছে নিজেদের। সকলের চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে যেন আমরাও পারি। অনুজদের জন্যও আগামীর পথটা কিছুটা হলেও সহজ করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞাকে তারা বাস্তবের রূপ দিয়েছে।
সাবিনারা নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে খুবই কম। এমন একটা সময় গেছে যখন মেয়েদের ফুটবলে স্পন্সরও জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তারা না পেয়েছে নিজেদের প্রয়োজনীয় ফুটবল সামগ্রী, না পেয়েছে নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ বা না পেয়েছে ঠিকঠাক একটা আবাসন ব্যবস্থা।
দশরথের ফাইনালের আগে সানজিদার ওই এক পোস্টেই যেন উঠে এসছিলো তাদের পেরিয়ে আসা সেই কঠিন সংগ্রামী জীবনের গল্প, 'পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।'
নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়েও তারা এসেছে লাল সবুজের স্বপ্ন পূরণে। ওই যে, নানা সীমাবদ্ধতায় নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু সবসময় দিতেও পারেনি তারা। তবে নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু দিতে পারলে যে বাংলার এই দামাল মেয়েরা কি করতে পারে সেটি তারা করে দেখিয়েছে হিমালয়ের দেশে সাফের এই ৬ষ্ঠ আসরেই।
গ্রুপ পর্বের সেই মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ থেকে শুরু, ফাইনালে স্বাগতিক দর্শকদের গগনবিদারী চিৎকার, বাংলার অপরাজিতাদের থামাতে পারেনি কেউই। উল্টো প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেনো বাঘের গর্জন শুনিয়ে যেন জানিয়ে দিয়েছে, এই উপমহাদেশের ফুটবলের নতুন রানি এসে গেছে রাজত্ব করতে।
শুরুর সেই মালদ্বীপ থেকে ফাইনালের নেপাল, সাবিনাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি কেউ। মালদ্বীপের বিপক্ষে ৩টি, পরের ম্যাচেই পাকিস্তানের জালে ৬ টি, আর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সব পরিসংখ্যান উল্টে ভারতের বিপক্ষে ৩ গোলের জয়। সেমিফাইনালে ভূটানের জালে দুই হালি গোল দিয়ে কৃষ্ণা-স্বপ্নারা যখন ফাইনালে, ততক্ষনে বাংলার গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী রুপনা চাকমার পেছনের জালে বল জড়াতে পারেনি কোনো প্রতিপক্ষই।
ফাইনালে উঠেও পা টা মাটিতেই ছিলো বাংলার সাহসিকাদের। জীবনের কড়িকাঠ পেরিয়ে বাস্তবতার স্বাদ পেয়ে গেছে যে তারাও। তাই তো নিজেদের উড়ন্ত পারফরম্যান্সের পরও ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেপালকে নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন সাবিনারা। ফাইনালের পরিবেশটাও ছিলো নেপালের পক্ষেই। স্বাগতিক হিসেবে ফাইনালে উঠেছে তারা, বাংলাদেশের বিপক্ষে সিনিয়র সাফে আগে কোনো হারের রেকর্ড নেই নেপালের মেয়েদের। ফাইনালের আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো দশরথ স্টেডিয়ামের সব টিকিট। প্রায় ১৫ হাজার সমর্থক তো তাদের হয়ে মাঠে দ্বাদশ প্লেয়ার হিসেবেই থাকার কথা ছিলো, তার ছিলেনও ঠিক তেমনই।
তবে জীবনের সেই শুরু থেকে যে সংগ্রাম পার করে সাবিনা-সানজিদারা আজকের জায়গায় দাঁড়িয়ে, তাদের কাছে তো এসব বাঁধা তুচ্ছ। ফাইনালের মঞ্চটা যেন তাদের কাছে জীবন সংগ্রামের আরেকটি অধ্যায়। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসা মেয়েদের সামনে নিতান্তই সহজ এই লড়াই জিততে সময় লাগলো মাত্র ১৪ মিনিট। রঙ্গশালার প্রায় ১৫ হাজার দর্শককে নিস্তব্ধ করে দিয়ে লাল-সবুজের গর্জন তোলার উপলক্ষ্যটা এনে দিলেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। এই শামসুন্নাহারের ফাইনালের গল্পটাই তো ছোট্ট একটা বাঁধা ডিঙ্গানোর। তিনি ছিলেন না প্রথম একাদশেই। স্বপ্নার চোটে ১০ মিনিটে বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই যেন দেখালেন নিজের সামর্থ্য। জানান দিলেন, সুযোগ পেলে গর্জন তুলতে প্রস্তুত বাংলার মেয়েরা।
শামসুন্নাহারকে দেখেই যেন রক্তে গর্জন উঠেছে লাল সবুজের নাম্বার নাইন কৃষ্ণার। ৪২ মিনিটে নেপালের অধিনায়কের মাথার উপর দিয়ে তার শট যখন জালে জড়ায়, ততক্ষণে বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে ফেটে পড়েছে ১৫ হাজার নেপালি দর্শকের ভিড়েও স্টেডিয়ামে উপস্থিত গুটিকয়েক বাঙালি। ওই গুটিকয়েকের গর্জন যেন ছাপিয়ে গিয়েছে ১৫ হাজার নেপালি দর্শকের গগনবিদারী চিৎকারকেও।
দ্বিতীয়ার্ধ্বে আচমকাই গোল খেয়ে বসে বাংলাদেশ। স্বাগতিক দর্শকরাও যেন শুরু করে দিলেন ঘুরে দাঁড়ানোর চিৎকার। একটু কি ভড়কে গেলো সাবিনারা? না, জীবনের যত সংগ্রাম পেরিয়ে এসেছে ওরা, তাতে এটুকুতেই ভড়কে যাবার মতো কিছুই যেন হয়নি। উল্টো বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর যে দৃঢ় মনোবল সেটিই যেন আরেকবার প্রমাণ করে দিল কৃষ্ণা। নেপাল ওই এক গোল শোধ দিয়ে যখনই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে, কৃষ্ণার আরেকটি গোল। যেন চোখে চোখ রেখে বলে দিলেন শত সহস্র বাঁধা আসলেও বারবার ঘুরে দাঁড়াবে বাংলার মেয়েরা।
২০০৩ এর ছেলেদের সাফের পর আবারও দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট এনে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলো সাবিনা-সানজিদারা। ওরা কথা রেখেছে, ওরা কথা রাখতে জানে। বাংলার বাঘিনীদের গর্জন শোনা গেছে হিমালয়ের চূড়া থেকে। দেশকে দিয়েছে ওরা, এবার দেশ ওদের কি দেবে? ওরা অবশ্য প্রতিদানে চায়নি কিছুই। ওই যে সানজিদা তো বলেই দিয়েছিলেন, 'ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনী কে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।'
ওদের প্রাপ্তি তো এই লাল-সবুজের পতাকাটাকে কিছু একটা দিতে পারার আহংকার। ওদের ওপর আস্থা রাখার মানুষগুলোর সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারার গর্ব। আর নিজেদের পেছনে ফেলে আসা বন্ধুর পথটায় আগামীর দিনগুলোতে আরেকটু মসৃণতা যদি আনা যায়।
সময় বলে দেবে ওরা কি নিজেদের সামান্য এই চাওয়া আর সম্মানটুকু পাবে কিনা। তবে ওরা যা দিয়ে গেলো তার সামনে হয়তো কোনকিছুই যথেষ্ট নয়। তবুও একটা কথা তো বলাই যায়। সাহসিকা, কুর্নিশ তোমাদের...