শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

অসুস্থ রওশনের চিঠি-বিবৃতি নিয়ে সন্দেহ, জাপার ধারণা তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে

  • একটি চক্র এটা-ওটা লিখে তার স্বাক্ষর নিচ্ছে: জি এম কাদের
  • রওশন তার ছেলেসহ কয়েক জনের কাছে জিম্মি: মুজিবুল হক চুন্নু
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৩০

ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের হঠাৎ ‘রাজনৈতিক তৎপরতা’ নিয়ে নানামুখী সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে দলটিতে। ৩১ আগস্ট গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে আগামী ২৬ নভেম্বর জাপার কাউন্সিল ডাকার পর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনে রওশনের নামে যে ২১টি ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ ও ‘বিবৃতি’ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আদৌ রওশনের কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জাপায়। এমনকি সর্বশেষ জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে কড়া ‘আদেশ-নির্দেশ’ দিয়ে রওশনের নামে যে চিঠি ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ আকারে সরবরাহ করা হয়েছে, সেটি সম্পর্কেও রওশন নিজে আসলে কিছু জানেন কি না, সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছেন দলের নেতাকর্মীরা।

জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান ও তিন জন প্রেসিডিয়াম সদস্য গতকাল বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে পৃথক আলাপকালে বলেন, বিবৃতি-চিঠি-সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলো যে রওশনের সেটির তো প্রমাণ মিলছে না। কারণ রওশন এরশাদ নিজে সরাসরি কোথাও কিছু বলছেন না, গণমাধ্যমকেও তিনি এড়িয়ে চলছেন। রওশন আদৌ তার নামে সরবরাহকৃত এসব চিঠি-বিবৃতির বিষয়ে অবহিত কি না, সে বিষয়েও সন্দিহান জাপার এই নেতারা। তাদের ধারণা, কোনো লক্ষ্য হাসিলে রওশনকে হয়তো ব্যবহার করা হচ্ছে।

দলের নেতাকর্মীদের এই সন্দেহ-সংশয়ের সঙ্গে একমত জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘রওশন এরশাদ অসুস্থ, হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। অসুস্থতা ও বয়স সবকিছু মিলিয়ে ঠিকভাবে বাছবিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থানে তিনি নেই। আমার ধারণা, তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র নিজেদের মতো করে কিছু একটা লিখে নিয়ে তার স্বাক্ষর নিচ্ছেন। কোথায়, কী কাগজে স্বাক্ষর করছেন সেটিও হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন না।’ প্রসঙ্গত, টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে রওশন দেশে-বিদেশে চিকিৎসাধীন।

সর্বশেষ জি এম কাদেরকে ‘আদেশ-নির্দেশ’ করা চিঠিতে রওশন স্বাক্ষর করেছেন ২০ সেপ্টেম্বর। সেটি প্রকাশ করা হয় পরদিন। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রওশন একটি টেবিলে বসে চিঠিটি পড়ছেন এবং সেটিতে স্বাক্ষর করছেন, গণমাধ্যমের কাছে এমন একাধিক ছবিও পাঠিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ। জি এম কাদেরকে লেখা রওশনের চিঠিটি বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো হয় মসিহর স্বাক্ষরে।

তবে রওশনের এই চিঠির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ চিঠিটি জি এম কাদেরকে রওশন কীভাবে কিংবা কার মাধ্যমে পাঠিয়েছেন, সেটি কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না। জি এম কাদেরকে রওশন চিঠি পাঠালে সেটি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিংবা প্রতিনিধির মাধ্যমে সরাসরি পাঠানোর কথা। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সরকারিভাবে রওশনের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) ও সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) রয়েছেন, তারাও কেউ রওশনের চিঠি নিয়ে জি এম কাদেরের কাছে যাননি। এমনকি ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ আকারে গণমাধ্যমে পাঠানো রওশনের চিঠিতে যে গোলাম মসিহ স্বাক্ষর করেছেন, তিনিও জি এম কাদেরের কাছে যাননি, তার পক্ষেও কাউকে চিঠি নিয়ে জি এম কাদেরের কাছে পাঠানো হয়নি। এছাড়া রওশন যদি জি এম কাদেরকে চিঠি দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জি এম কাদেরকে কিংবা তার কোনো দায়িত্বশীল প্রতিনিধির কাছে না পাঠিয়ে তা কেন ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ আকারে প্রচার করা হলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

রওশনের ‘আদেশ-নির্দেশ’ সংবলিত চিঠির বিষয়ে জি এম কাদের ইত্তেফাককে বলেন, ‘এই ধরনের কোনো চিঠি আমি পাইনি, দেখিওনি।’ রওশনের চিঠি পাননি বলে জাপা চেয়ারম্যানের বক্তব্যের বিষয়ে রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ ইত্তেফাককে বলেন, ‘ওনাকে চিঠি অফিসিয়ালি পাঠানো হয়েছে। 

বিরোধীদলীয় নেতার অফিস থেকে পাঠানো হয়েছে। ই-মেইলেও হয়তো পাঠানো হয়েছে।’ তবে কীভাবে, কে বা কারা চিঠি জি এম কাদেরের কাছে পাঠিয়েছেন সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি গোলাম মসিহ।
রওশনের চিঠির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও। গতকাল জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, ‘রওশন এরশাদের যে চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেটি আমরা আমলেই নিচ্ছি না।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, ‘রওশন এরশাদ পার্টির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কিছু করছেন বলে বিশ্বাস করি না। তবে ম্যাডাম তার ছেলে ও আরো দুই-একজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।’

জাপার সর্বশেষ কাউন্সিলে গৃহীত গঠনতন্ত্র পালটে ফেলা হয়েছে বলে দলের সকল পদ-পদবি খোয়ানো মসিউর রহমান রাঙ্গা যে অভিযোগ তুলেছেন, সে বিষয়ে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘জাপার গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে এবং ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। প্রয়োজনে যে কেউ দেখে নিতে পারেন।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাপা ঐক্যবদ্ধ আছে। পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। কোনো ষড়যন্ত্রই জাপার ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারবে না।’

রওশনের চিঠি-বিবৃতি-সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই প্রতিবেদক নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। কয়েক দিন ধরে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করছেন না। মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে এসবের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে, বার্তাগুলো দেখলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। একইভাবে রওশনপুত্র সাদও কয়েক দিন ফোন ধরছেন না। তাকেও মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। রওশনের মতো সাদও বার্তাগুলো দেখলেও কোনো উত্তর দেননি।

সর্বশেষ গতকাল বিকালেও রওশন এরশাদকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। কিছুক্ষণ পর জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ‘হুসেইন মু‏হম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ এই প্রতিবেদককে ফোন করে বলেন, ‘আমি এখন ব্যাংককে ম্যাডামের পাশেই আছি। ম্যাডামের থেরাপি নিতে হয়, ডাক্তার আসেন, বিশ্রামে থাকেন ইত্যাদি নানা কারণে তিনি ফোন ধরতে পারছেন না।’ এক প্রশ্নের জবাবে কাজী মামুন বলেন, ‘রওশন এরশাদের চিঠি-বিবৃতি নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন উঠতে না পারে সেজন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, এখন থেকে সবকিছু তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহর স্বাক্ষরে যাবে। আর যে কোনো বিষয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরাই এখন রওশন এরশাদের পক্ষে দায়িত্বশীল ব্যক্তি।’ 

জানা গেছে, রওশনের মোবাইল ফোনের নিয়ন্ত্রণও এখন অন্যদের হাতে। রওশন যাতে সরাসরি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন, সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিশেষ কোনো প্রয়োজনে রওশন কারো সঙ্গে কথা বললেও সে সময় তার পাশে অন্যরা পাহারা দিচ্ছেন।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি