শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

৩৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা কি আইওয়াশ?

আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২৩:০০

কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর অভিযোগে দেশের শীর্ষ ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। এপর্যন্ত ১১টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুনানি হয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মোট ৪৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্য প্রস্তুত ও সরবরাহকারী ৩৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ৪৪টি। বাকি মামলাগুলো কসমেটিকসসহ অন্য পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে।

অবশ্য এই মামলা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কেউ এটাকে ইতিবাচক বললেও কেউ কেউ বলছেন আইওয়াশ। তাদের কথা কঠোর আইন থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামুলি আইনে মামলা হচ্ছে।

যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- এস আলম গ্রুপ, স্কয়ার, ইউনিলিভার, বসুন্ধরা, প্রাণ, এসিআই, সিটি গ্রুপ, আকিজ, মেঘনা, এসিআই, ব্র্যাক সিড, কেয়া কসমেটিকস, কোহিনুর কেমিক্যালস।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টস, দিনাজপুরের জহুরা অটো রাইস মিল, নওগাঁর বেলকন গ্রুপ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এরফান গ্রুপ, বগুড়ার কিবরিয়া অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি, নওগাঁর মফিজ উদ্দিন অটোমেটিক রাইস মিল, বগুড়ার আলাল অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নুরজাহান অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, বগুড়ার খান অটো রাইস মিল, কুষ্টিয়ার মেসার্স দাদা রাইচ মিল, নওগাঁর মজুমদার অটো রাইস মিল, নারায়ণগঞ্জের সিটি অটো রাইস অ্যান্ড ডাল মিলস, নওগাঁর ম্যাবকো হাইটেক রাইস ইন্ডাস্ট্রিজের। এরা মূলত চাল ব্যবসায়ী।

এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের অভিযোগ, তারা বাজারে চাল, আটা, ময়দা, ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও টয়লেট্রিজ পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অস্বাভাবিক মুনাফা করে আসছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে চাল-ডাল, আটা-ময়দা, তেল, ডিম, মুরগির মতো নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে ক্রেতা ঠকিয়ে আসছিল তারা। তারা বাজার থেকে তুলে নিচ্ছিল বাড়তি মুনাফা। এসব বিষয়ে আমাদের কাছে অনেক লিখিত অভিযোগ আসে। এর বাইরে কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়েও বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করে। তদন্তে এসব প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও আছে।

প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের ১৫ ও ১৬ ধারা অনুযায়ী তাদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১৫ ধরায় বলা হয়েছে, বাজারে প্রভাব বিস্তার  করে একপক্ষীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে তারা শাস্তির আওতায় আসবে। আর ১৬ ধরায় বলা হয়েছে, কোনো পণ্যের বাজারজাত বা উৎপাদনে শীর্ষে থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে পণ্যের দামে কারসাজি করলে সেই অপরাধও শাস্তিযোগ্য।

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, আইনে সতর্ক ও ভর্ৎসনা করা ছাড়াও আমরা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাৎসরিক টার্নওভারের শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত জরিমানা করতে পারি। আমাদের শুনানি চলছে। শুনানি শেষে অপরাধ প্রমাণ হলে আমরা শাস্তি দেব।

এনিয়ে সিটি গ্রুপ, ইউনিলিভারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেননি। কেউ আবার ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান।

এই কমিশন আগেও কয়েকটি মামলা করেছিলো। তাতে সতর্ক ও ভর্ৎসনা ছাড়া আর কোনো শাস্তির কথা জানা যায়নি। তবে  কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের( ক্যাব) এস এস নাজের হোসেন বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি নতুন। আগে তারা খুব বেশি মামলা করেনি। এবারই প্রথম তারা দেশে শীর্ষ ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহারের পণ্য উদপাদনকারী ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করল। এখানে শেষ পর্যন্ত কী শাস্তি হয় সেটা আমরা দেখার অপেক্ষায় আছি। তবে এটা একটা ইতিবাচক উদ্যোগ। এই প্রথম শীর্ষ এবং ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে। তারা যে কারসাজি করে দাম বাড়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানই মামলা করে সেই অভিযোগ প্রকাশ্যে আনে। এর একটা ইতিবাচক দিক আছে।”

তিনি আরো বলেন, তবে এরা সবাই উচ্চ আদালতে যাবেন বলে আমার মনে হয়। তখন কী হবে তা বলা যায় না।

এর আগে ভোক্ত অধিদপ্তর ভোজ্যতেল নিয়ে শীর্ষ আমদানিকারক ও ডিলারদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো। তাদের নোটিস করে শুনানিও করা হয়। তবে কার্যকর কোনো শাস্তি বা ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশনের এই মামলা দিয়ে কী হবে! তারা তো তেমন কোনো শাস্তি দিতে পারে না। তাদের কাজ হলো বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা। মজুত করে, সিন্ডিকেট করে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করার বিধান আছে। আর তার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড।

তার কথা, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা যে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে তার বিস্তারিত বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তাই আমার বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে যে আইনে মামলা হওয়া উচিত সেই আইনে না করে ওই মামুলি আইনে মামলা করা হয়েছে। এটা তাদের রক্ষায় আইওয়াশ বলেই আমার মনে হয়।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি