শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটা সম্পূর্ণ ভন্ডামি: চীনের রাষ্ট্রদূত

আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:১২

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, বাংলাদেশের জরুরী প্রয়োজনে এবং উভয় পক্ষের সম্মতির মাধ্যমে বাংলাদেশ চী্না ঋণ গ্রহণ করে। এসব ঋণের কোন অযৌক্তিক শর্ত নেই। চীনের অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পগুলি সবসময় সময়ানুবর্তিতা এবং ব্যয় কার্যকারিতার সাথে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ চীনের সরল বিশ্বাসকে ব্যাপকভাবে স্বীকার করে। প্রচলিত‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটা সম্পূর্ণ ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। দৈনিক ইত্তেফাককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে চীনা রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেন। 

রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। চীন সবসময় বলে আসছে যে সমস্যাটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা উচিত। আমরা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয়কেই সমর্থন দিয়ে আসছি, যার লক্ষ্য অবস্থার উন্নতি করা এবং প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।

  • ইত্তেফাক: চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দেশগুলো চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ে-এমন অভিযোগের ওপর আপনার মন্তব্য কী?

লি জিমিং: এ ব্যাপারে আমি আমার মতামতের পুনরাবৃত্তি করেছি বহুবার। তথাকথিত ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটা সম্পূর্ণ ভন্ডামি। আমি সকল বাংলাদেশী বন্ধুদের এটা বর্জন করার আহ্বান জানাই।

বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের ঋণের সাথে জিডিপি অনুপাত হল ৩১ দশমিক ৪২ শতাংশ, এবং বৈদেশিক ঋণ সামগ্রিক ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৮ শতাংশ। অন্যান্যদের মধ্যে, চীনের ঋণ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৮ শতাংশ- যা আইডিএ এবং এডিবির মতো বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং জাপান ও রাশিয়ার মতো দ্বিপাক্ষিক উৎস থেকে পিছিয়ে।

বাংলাদেশের জন্য, চীন থেকে অর্থায়ন দারুন সুবিধা এনে দেয়। এটি সর্বদা বাংলাদেশের জরুরী প্রয়োজনে এবং উভয় পক্ষের সম্মতির শর্তে আসে। চীনা অর্থায়নে কোন অযৌক্তিক শর্ত নেই। এবং চীন দ্বারা অর্থায়ন করা এবং নির্মিত প্রকল্পগুলি সর্বদা সময়ানুবর্তিতা এবং ব্যয় কার্যকারিতার সাথে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ চীনের সরল বিশ্বাসকে ব্যাপকভাবে স্বীকার করে।

আপনি যদি 'যেকোনো দেশ' বলে শ্রীলঙ্কার কথা উল্লেখ করেন, তাহলে সেখানে বর্তমান সংকটের কারণ কী তা আপনাকে দেখতে হবে। ২০১৯ সালের ইস্টার বোমা হামলার পর পর্যটন রাজস্বের তীব্র পতন, কিছু অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন, বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে রেমিট্যান্স সঙ্কুচিত হওয়া, খাদ্য ও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দামের কারণে শ্রীলঙ্কা সমস্যায় পড়েছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, কিছু দেশের একতরফা নিষেধাজ্ঞা, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেংগে পড়া, এবং মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ানোয় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। 

বিদেশী ঋণের ইস্যু শ্রীলঙ্কার আর্থিক বিশৃংখলায় অবদান রাখতে পারে, তবুও চীনকে বলির পাঁঠা বানানো অযৌক্তিক। এডিবি শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ একক ঋণদাতা। আর জাপান ও চীনের কাছে দেশটির ঋণ প্রায় সমান। তাহলে চীনকে দোষারোপ কেন? আমি আমাদের সম্মানিত পাঠকদের এটি সম্পর্কে চিন্তা করার আহ্বান জানাই।

  • ইত্তেফাক: একটি অভিযোগ রয়েছে যে, চীনা ঋণের শর্ত অনেক কঠোর এবং গ্রেস পিরিয়ড খুব কম। আপনার মন্তব্য কি?

লি জিমিং: যথাযথ সম্মানের সাথে আমি এই ধরনের অভিযোগের সাথে একমত নই। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে সরকারের ইআরডি সহকর্মীরা অবশ্যই আমার পাশে থাকবেন। আসলে, চীনা প্রস্তাবগুলি অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক। চীনা তহবিলের সিংহভাগই আসে দীর্ঘমেয়াদী এবং সফট লোন হিসেবে। দ্য ডিপ্লোম্যাটের মতে, এই ঋণের গড় সুদের হার প্রায় ১ দশমিক ২৩ শতাংশ, এবং বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের জন্য গড়ে ৩১ বছর সময় রয়েছে, যার গড় গ্রেস পিরিয়ড ৮ বছর।

অধিকন্তু, চীনা অর্থায়নে কোন অযৌক্তিক শর্ত নেই। কিছু পশ্চিমা ঋণদাতাদের কাছ থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব সবসময় রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক সংস্কারের মতো পূর্বশর্ত নিয়ে আসে-এমন তিক্ততার স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। এটি চীনা ঋণের ক্ষেত্রে কখনই নয়। বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে, চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে এবং ন্যায্য অর্থায়নের চেষ্টা করে।

  • ইত্তেফাক: বাংলাদেশ কিভাবে চীনা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে?

লি জিমিং: ২০২১ সালে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার এবং প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৩ বিলিয়ন বিনিয়োগের সাথে, চীন বাংলাদেশের জন্য একটি বিশিষ্ট বিদেশী বিনিয়োগের উৎস হিসাবে রয়ে গেছে। একটি সুসংবাদ হল যে, চট্টগ্রামে চীনের অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল নির্মিত হবে, যা যুগান্তকারী তাৎপর্যপূর্ণ। আশা করা যায় যে দেশের উৎপাদন শিল্প এবং শিল্প কাঠামোর উন্নতির জন্য আরও চীনা উদ্যোগ এখানে বিনিয়োগ আকৃষ্ট হতে পারে।

  • ইত্তেফাক:  আপনি কি বাংলাদেশে চীনা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে খুশি?

লি জিমিং: হ্যা অবশ্যই। চীনের অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পগুলি সবসময় চুক্তির মুল চেতনায় অটল থাকে এবং সময়ানুবর্তিতা এবং কার্যকরী ব্যয়নীতি এর সাথে যুক্ত থাকে।  বিশ্বব্যাপী মহামারী এবং অস্বস্তিকর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, সাহসী এবং সৎ চীনা নির্মাতারা এগিয়ে চলেছেন। চলতি বছরের শুরুতে আমরা পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ হতে দেখেছি। পরে দশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ শেষ হয়। চলতি মাসের শুরুতে চীনের সহায়তায় নির্মিত ও বঙ্গমাতার নামে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুরও উদ্বোধন করা হয়েছে। কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্পও এ বছরের শেষ নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

  • ইত্তেফাক:  রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সমস্যা সমাধানে চীনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

লি জিমিং: রোহিঙ্গা ইস্যুতে, চীন দুই দেশের মধ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। চীন সবসময় বলে আসছে যে সমস্যাটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা উচিত। আমরা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয়কেই সমর্থন দিয়ে আসছি, যার লক্ষ্য অবস্থার উন্নতি করা এবং প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। গত বছরের শুরুর দিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা একসময় স্থগিত হয়ে যায়। যাইহোক, সমস্যা সমাধানের ইচ্ছা দুই বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনে।  আমরা সকল সমমনা দেশকে একই কাজ করার আহ্বান জানাই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্থায়ী সমাধান খোঁজার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।

  • ইত্তেফাক: চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ ওয়াং ই’র বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?

লি জিমিং: চীন ও বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদার। চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ ওয়াং ই-এর সফরের লক্ষ্য হচ্ছে বন্ধুত্ব অব্যাহত রাখা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার উন্নতি ঘটানো। ঢাকায় আগমনের পর, মিঃ ওয়াং প্রথমে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন, যেখানে তিনি দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ইতিহাস স্মরণ করেন । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চীনা পক্ষের প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশ চীনের প্রতি বন্ধুত্বকে লালন করে বলে উল্লেখ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, শান্তি বজায় রাখা এবং অভিন্ন উন্নয়ন অর্জনের জন্য বাংলাদেশ চীনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে। বাংলাদেশ এক-চীন নীতিতে অটল থাকবে এবং তাইওয়ানকে চীনা ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখবে। উভয় পক্ষ উন্নয়ন কৌশল নিয়ে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং ভিশন ২০৪১ পরিপ্রেক্ষিতে অবকাঠামো, ডিজিটাল অর্থনীতি, সবুজ উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও গভীর হবে। চীনে বাংলাদেশের রপ্তানিকে আরও উত্সাহিত করার জন্য, চীনা পক্ষ বাংলাদেশ থেকে উদ্ভূত ৯৮ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার ঘোষনা দিয়েছে। উভয় পক্ষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। আমরা একটি নতুন সংস্কৃতি ও পর্যটন বিনিময় কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করেছি এবং দারিদ্র্য নিরসনে বিনিময় ও সহযোগিতাকে উন্নত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

  • ইত্তেফাক: আপনার কাছে বঙ্গমাতা সেতুর তাৎপর্য কী?

লি জিমিং: চীন ১৯৮৯ সাল থেকে চীন সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে মেগা সেতু নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। "বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু" একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা সেতুটি এ ধরনের অষ্টম ব্রীজ। এই ব্রীজের নামকরন থেকে বুঝতে পারা যায় ,বংগবন্ধু এবং বংগমাতা  আমাদের বন্ধুত্বকে কিভাবে লালন করে।

গত চার বছর ধরে, চীন ও বাংলাদেশের নির্মাতারা যৌথভাবে সেতুটি নির্মাণ করেছেন। নির্মাণের সময়, সেতুটিতে ১৫০ জন চীনা প্রকৌশলী এবং ৬০০ জনের বেশি স্থানীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিক জড়িত ছিল। উদ্বোধনের পর, সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নকে শক্তিশালী করবে। এটি বাংলাদেশের ভিশন ২০৪১ পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর নিখুঁত চিত্র হিসাবে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুত্বের এমন মূল্যবান ঐতিহ্যকে অব্যাহত রাখতে চীন নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণের সংকল্প করেছে। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

 

ইত্তেফাক/ইআ