পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের মূল যন্ত্র রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পারমাণবিক চুল্লি) স্থাপন কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। আগামী ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজের উদ্বোধন করবেন। পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন অনুষ্ঠানকে ঘিরে ঈশ্বরদীর রূপপুরে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।
এই অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করার জন্য সোমবার (১৭ অক্টোবর) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সকলের মধ্যে কর্মব্যস্ততা দেখা গেছে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাশিয়ার পরমাণু শক্তি সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ। তিনি ১৯ অক্টোবর সকালে হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে অনুষ্ঠনস্থলে যাবেন বলে জানা গেছে।
রোববার (১৬ অক্টোবর) থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান রূপপুরে অবস্থান করছেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সোমবারের (১৬ অক্টোবর) মধ্যেই রূপপুর পৌঁছাবেন। ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরাও আসতে শুরু করেছেন। পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন সম্প্রচারের জন্য প্রায় ৫০ জন সংবাদকর্মী ঢাকা থেকে পাবনা যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। এছাড়া বিদেশি সাংবাদিকরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন বলে প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, বাংলদেশে পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতির পিতা ও তার কন্যার প্রতি বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ। রাশিয়া বাংলাদেশের দুঃখের দিনের বন্ধু। পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব সভ্যতায় অনন্য অবস্থানে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।
প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি। এরই মধ্যে প্রথম ইউনিটের ৭৫ ভাগ ভৌত-অবকাঠামো কাজ সম্পন্ন হয়েছে। একইসঙ্গে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়ায় এখানে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন হচ্ছে। প্রতিটি যন্ত্র সর্বোচ্চ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নকশা অনুযায়ী বসানো হচ্ছে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সনদ নিতে হয়েছে।
এর আগে, ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন উদ্বোধন করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় প্রকল্প। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও রূপপুরের কাজ একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। প্রতিদিন তিন শিফটে দেশি-বিদেশি প্রায় ২৫-২৬ হাজার মানুষ এই প্রকল্পে দিনরাত কাজ করেছেন।
কি কি বসবে রিয়াক্টর ভবনে?
প্রকল্প এলাকায় গোলাকৃতি যে দুটি ভবন সেগুলোই রিয়াক্টর ভবন। এদের মধ্যে একটিতে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর বসানো হয় প্রথম ইউনিটের রিয়াক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লি।
রিয়াক্টর প্রেসার ভেসেলকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হার্ট বা হৃদপিণ্ড বলা যেতে পারে। এই ভবনের বিভিন্ন ধাপে বসানো হয়েছে নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতি। পাঁচ রকমের যন্ত্রের মধ্যে ইতোমধ্যে প্রেসারাইজার, কুল্যান্ট পাম্প এবং হাইড্রো অ্যাকুমুলেটর বসানো সম্পন্ন হয়েছে। রিয়াক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের পরপরই স্থাপন করা হবে স্টিম জেনারেটর। এর মাধ্যমে সব ধরনের নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতি বসানো শেষ হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পটভূমি:
১৯৬০ সালে পাকিস্তান আমলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ১৯৬২ হতে ১৯৬৮ সালের মধ্যে পদ্মা নদীর তীরে ঈশ্বরদীর রূপপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এ সময়কালে প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসনের জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করে নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এটিকে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৪ সালের দিকে এখানে ২০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর এই প্রকল্প অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়।
১৯৭৭-১৯৮৬ সালের এম এস সোপরাটম ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রটি দ্রুত নির্মাণের পরামর্শ দেয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানির উদ্যোগে আরেকটি ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করা হয়। এই স্টাডি পূর্বের স্টাডিকেই সমর্থন করে। এ সময় ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় একনেকে। কিন্তু অর্থের যোগান না থাকায় এটি স্থগিত হয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য জার্মানির সাথে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘জাতীয় জ্বালানি নীতি-১৯৯৬’ এ রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নেট সুপারিশ করে। এ সময় দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া প্রকল্পটির বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৭-২০০০ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ওয়াজেদ মিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্লান অনুমোদন গ্রহণ করা হয়। সেসময় ওয়াজেদ মিয়া রূপপুরে গিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে ওয়াজেদ মিয়া রূপপুরে গেলে রূপপুরবাসী তাকে সংবর্ধনা দেয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আবারো প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ স্তিমিত হয়।
রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পাদিত কার্যাবলী:
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ান রোসাটম ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং রাশিয়ান সরকারের মধ্যে ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ৮টি সাব গ্রুপ গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে প্রকল্প নির্মাণে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুর অধ্যায়:
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সময় রাশিয়ান ফেডারেশনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সের্গেই কিরিয়েঙ্কো এবং বিভিন্ন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের পর থেকেই দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণে মহাকর্মযজ্ঞ চলছে। প্রকল্পে কর্মরত সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় দিন-রাত অকান্ত পরিশ্রম করে কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান প্রতি মাসেই এক-দুইবার রূপপুরে গিয়ে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছেন।