শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নকল মোড়কে আখের ভেজাল চিনি, ঠকছেন ক্রেতারা

আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৫৭

আজকাল ভেজাল ছাড়া খাবার যেন হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ। আখের খাঁটি চিনি কিনতে গিয়ে ঠকছেন সাধারণ মানুষ। মোড়ক পাল্টে ‘হবহু’ নকল চিনি বিক্রি করছেন এক শ্রেণির বিক্রেতা। এমন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার পর ভোক্তা অধিকার বলছে, তাদের অভিযান চলমান রয়েছে। দেখতে একই রকম হলেও ভেজাল এসব চিনির কারণে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্য সচেতন ক্রেতারা সবসময় চেষ্টা করেন ভেজাল মুক্ত খাঁটি খাদ্য পণ্য কেনার। চিনির ক্ষেত্রে ক্রেতারা তাই পরিশোধিত ক্ষতিকর চিনির পরিবর্তে বেছে নেন চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের উৎপাদিত আখের হালকা বাদামী রঙের দেশি চিনি। কিন্তু ব্যাপক চাহিদার তুলনায় এই চিনির যোগান কম। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা চিনি কর্পোরেশনের উৎপাদিত আখের চিনির মোড়ক হুবহু নকল করে কৃত্রিম রঙ ও কেমিক্যাল মিশিয়ে নিম্নমানের চিনি বাজারজাত করেছে। আখের তৈরি চিনি যা কেজি হিসেবে ১১০ হতে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানের সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকায়। দোকানি বেশি লাভের আশায় এ ধরণের ভেজাল চিনি বিক্রি করছেন।

রঙ মিশ্রিত ভেজাল চিনি

রাজধানীর কারওয়ানবাজার, মিরপুর, ধানমন্ডি, বাড্ডা, ভাটারা, বসুন্ধরা, খিলক্ষেত, উত্তরা, খিলগাঁও, রামপুরা, যাত্রাবাড়ি, ডেমরাসহ পুরান ঢাকার কিছু এলাকায় বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্ষতিকর রঙ ও কেমিক্যাল মেশানো চিনিতে বাজার সয়লাভ। দোকানি বেশি লাভের আশায় এ ধরনের ভেজাল চিনি বিক্রি করছেন।

বসুন্ধরার এলাকার গেইটে অবস্থিত বাজার হতে আখের দেশি চিনি কেনেন ইয়াকুব হোসেন। বাসায় গিয়ে চিনির প্যাকেট দেখে সন্দেহ হয়। বাসায় চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের চিনিকলে উৎপাদিত আগের প্যাকেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন তার সদ্য কেনা আখের চিনির প্যাকেটের চিনি গাড় বাদামী ও প্যাকেটের গায়ের এককোনে ‘সজীব’ লেখা। এর পর দুইটি আলাদা পাত্রে পানিতে চিনি মিশিয়ে দেখেন। প্রকৃত চিনির শরবত স্বাভাবিক সাদা কালার হলেও রঙ ও কেমিক্যাল মিশ্রিত চিনির শরবত হলদেটে রঙ ধারণ করে। পরে দোকানির কাছে চিনি নিয়ে গেলে দোকানি ও ইয়াকুব হোসনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের চিনিকলে উৎপাদিত আখের হালকা বাদামী রঙের খাঁটি দেশি চিনি

আখের আসল ও ভেজাল চিনি নিয়ে বিক্রেতা সানোয়ার মিয়া ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘ভোক্তা পর্যায়ে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে সরকারি আখের চিনির। কিন্তু সরকারি আখের চিনির সরবরাহ অপ্রতুল। দেশি চিনির সরবরাহ এবং দাম ঠিক নেই। কোনো দিন পাওয়া যায়, কোনো দিন যায় না। খাঁটি আখের দেশি চিনিতে লাভ কম তবে ভেজাল দেশি আখের চিনিতে লাভ হয়’।

দেখা গেছে, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সাদা চিনিতে ক্ষতিকর রঙ মিশিয়ে ‘বাদামী চিনি’ নামে বেশি দামে বিক্রি করছে। বিভিন্ন কোম্পানির নাম দিয়ে সেগুলো রাজধানীসহ সারা দেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। এসব চিনি মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ২২ ও ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি দোকান থেকে ২০০ কেজির বেশি লাল চিনি জব্দ করে ধ্বংস করেছে।

অভিযানে কারওয়ান বাজারের কয়েকটি খুচরা দোকানে ‘সতেজ’, ‘গাংচিল’, ‘কেয়া’, ও ‘খাটি’সহ হরেক নামে বাদামী চিনি বিক্রি হতে দেখে সন্দেহ হলে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পাইকারি বিক্রেতার সন্ধানে নামে ভোক্তা অধিদপ্তর।

রঙ মিশ্রিত আখের ভেজাল চিনি

এসময় মেসার্স বেলায়েত স্টোরে ধরে পড়ে বাদামী চিনি। সেখানে অভিযান চালিয়ে ২০০ কেজির বেশি ক্ষতিকর বাদামী চিনি জব্দ করা হয়। এসব বাদামী চিনি আসল না নকল যাচাই করতে বেলায়েত স্টোরেই চিনিতে পানি দিলে চিনি থেকে রং আলাদা হয়ে যায়। আর চিনি ধূসর সাদা হয়ে যায় এবং পানি কিছুটা বাদামী রং ধারণ করে। এসব চিনি কোথা থেকে আনা হয়েছে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটির মালিক। বিক্রেতার কাছে কোনো ক্যাশ মেমোও পাওয়া যায়নি। তাই ক্ষতিকর এসব চিনির প্যাকেট জনসাধারণের সামনে ধ্বংস করা হয় এবং প্রতারণার অপরাধে বেলায়েত স্টোরকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এছাড়া কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় এ আর এন্টারপ্রাইজেও ৩৯ বস্তা লাল চিনি পাওয়া যায়। এই প্রতিষ্ঠানকে সাত দিন জনস্বার্থে দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে ডাকা হয়। 

জব্দকৃত ভেজাল চিনি

ভেজাল চিনির অভিযানের বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্পের যে লাল চিনি রয়েছে তার আদলে সাদা চিনির মধ্যে টেক্সটাইল রঙ ব্যবহার করে লাল চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হচ্ছিল। এসব চিনি যারা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করছে তাদের নির্ধারিত কোনো ঠিকানা প্যাকেটের মোড়কে নেই। প্যাকেটে শুধু ঢাকা, বাংলাদেশ লেখা রয়েছে। এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

বাজারের রঙ মিশ্রিত ভেজাল চিনির ক্ষতিকর দিক বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মাসুম বিল্লাহ ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘এসব চিনি খেলে মানব শরীরে নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এ ভেজাল চিনি বিশেষ করে শিশুদের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। এমনকি এসব চিনি খাদ্যে মিশিয়ে ব্যবহার করা হলে প্রথমেই কিডনি আক্রান্ত হবে, এরপর উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে হৃদরোগের ঝুঁকি এবং পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে’।

ইত্তেফাক/এসসি/এনএ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন