বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জ্বালানিসংকট শিগগিরই কাটছে না!

আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৫

ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জ্বালানির সংকট সামনে আরো তীব্র হতে পারে। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর ঘটানো একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। নবায়নযোগ্য বা পরিচ্ছন্ন জ্বালানি বলতে সৌর ও বায়ু ও স্রোত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বোঝায়। বিশ্বের বৃহৎ জ্বালানি এজেন্সি গত সপ্তাহে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে।

ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের ফলে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে যে ছেদ পড়েছে, সেটা এখন কোনো নতুন কথা নয়। এর ফলে অনেক দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি বেশি ব্যবহার করছে। কোনো কোনো দেশের এই ব্যবহারের পরিমাণ অপরাপর দেশের চেয়ে বেশি। তবে সেটা বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করে না ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইএই)। ২৭ অক্টোবর আইএইর প্রকাশিত ৫২৪ পৃষ্ঠার ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুকে এ মন্তব্য করা হয়েছে। রিপোর্টে আগামী ৩০ বছরে বৈশ্বিক জ্বালানি প্রবণতা সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্যাসের বদলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এতটা বেড়েছে যে নিকট ভবিষ্যতে এতে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি কারণ, এ বছর অনেক দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। এটি করতে গিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। নরায়নযোগ্য জ্বালানি, যা ক্লিন এনার্জি নামে পরিচিত, সেই পথে অগ্রসর হতে গেলে প্রাথমিক পর্যায়ে অবকাঠামো ও সেটি চালু করতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানির দরকার হয়। ক্লিন এনার্জি অবকাঠামোর মধ্যে আছে বায়ু টার্বাইন, সোলার প্যানেল, পরমাণু পাওয়ার প্ল্যান্ট, হাইড্রোজেন জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও বৈদ্যুতিক হিট। মার্কিন কংগ্রেস সম্প্রতি ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের আওতায় নতুন জ্বালানি প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য ৩৭০ বিলিয়ন ডলারের একটি বিল অনুমোদন করেছে। অন্যদিকে জাপানে ‘গ্রিন ট্রান্সফরমেশন’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরমাণু, হাউড্রোজেন ও স্বল্প নির্গমন প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়াও নবায়নযোগ্য ও পরমাণু শক্তির উন্নয়ন নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বা করতে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে যে গতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে হাঁটার কথা ছিল, সেটি এত দিনেও হয়নি। আইইএ বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের কাজটি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে করা না গেলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা থেকে এই গ্রহকে রক্ষা করা যাবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়লে কয়লা, গ্যাস ও জীবাশ্ম বা প্রাকৃতিক তেলের ওপর নির্ভরশীলতা আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে অনেকটা কমিয়ে আনা যাবে। আইইএর প্রজেকশন অনুযায়ী ক্লিন এনার্জি খাতে বর্তমানে বৈশ্বিক বার্ষিক বিনিয়োগ ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০৩০ সালে সেটি ২ ট্রিলিয়নে পৌঁছাতে পারে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরল বলেন, ‘জীবাশ্ম থেকে ক্লিন এনার্জিতে রূপান্তরের কাজটি কেবল জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের জন্য করা হবে তা নয়, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জাতীয় শিল্পনীতির অংশ হিসেবেও এটি করা হবে।’ ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা কার্বন নির্গমনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখতে সম্মত হয়েছিলেন। তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ধরে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ কমানো প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা এরই মধ্যে ১৯৯০ সালের তুলনায় ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। ১৯৩টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৬টি দেশ এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে। অন্য অনেক দেশ বিভিন্ন রকম উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিলেও আশাপ্রদ ফল আসেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে ক্লিন এনার্জির চাহিদা বেড়েছে। এর জন্য এখন বায়ু টার্বাইন, সোলার প্যানেল, পরমাণু পাওয়ার প্ল্যান্ট, হাইড্রোজেন জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরি করতে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হবে। এর ফলে একদিকে যেমন কার্বন নির্গমন বাড়বে, তেমনি ইউরোপ ও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ আগামী বছরের মধ্যেই ৫০ গিগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানিকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এই কাজের জন্য চলতি বছর কয়লাবিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় শীর্ষ দেশগুলোর একটি রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ইউরোপে এই জ্বালানি সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে মস্কো। ইউরোপের দেশগুলোকে তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরির ইঁদুর দৌড়ে নামতে হচ্ছে, যার মূল্য শেষ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়েই দিতে হবে বলে মনে হয়।

 

 

ইত্তেফাক/ইআ