বুধবার, ৩১ মে ২০২৩, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

পদবি মিললেও পদ মিলবে না হাজার কর্মকর্তার

আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২২, ০৮:১০

পদোন্নতির মাধ্যমে ‘পদবি’ মিললেও পদ পাবেন না হাজার কর্মকর্তা। কারণ, উচ্চতর পদে যে সংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে সে সংখ্যক পদ সংশ্লিষ্ট স্তরে নেই। দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের এই অব্যবস্থাপনা চলে এলেও তা দূর করার কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয় না। এই সমস্যাসহ প্রশাসনের নানাবিধ সমস্যা দূর করার তাগিদ দিয়ে একাধিক সংস্কার প্রস্তাব এখন কোথায় কীভাবে আছে তা কেউ বলতেও পারেন না।

গত এক বছরে শুধু যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে তিন বার। সমভাবে অনিবার্য কারণে অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব পদেও পদোন্নতি দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মকর্তার নির্দিষ্ট পদে নির্ধারিত সময়কাল অতিবাহিত হলে তিনি পদোন্নতির যোগ্য হন। এর পাশাপাশি ঐ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত এবং কর্মক্ষেত্রে আচার-আচরণ দক্ষতা বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বলা হয়েছিল পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কি না তাও বিশেষভাবে দেখা হবে। যদিও সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে।  

বাংলাদেশ সচিবালয়। ছবি- সংগৃহীত

পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা বিদ্যমান অব্যবস্থাপনায় এখন আর খুব একটা অসম্মান বোধ করেন না। তাদের বেশির ভাগই চান বেতনক্রম বাড়ুক আর পদবি উচ্চ হোক। তাতে সামাজিক সম্মান আর বাড়তি টাকা পাওয়া যাবে। সমাজের কে বুঝবে যে কে কোথায় বসে কোন পদে চাকরি করছেন বা আদৌ বসার জায়গা পাচ্ছেন কি না। বরং পদোন্নতি না পেলে পরিবার ও সমাজের চোখে ছোট হতে হয়। সচিব হতে না পারা এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তার স্ত্রী পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় যুক্ত একজন কর্মকর্তাকে ফোন করে বলেছেন, ‘পদোন্নতির পর যদি তার স্বামীর মৃত্যুও হয় তাতেও তার দুঃখ নেই।’

সর্বশেষ গত বুধবার ১৭৯ উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্মসচিব করা হয়। জনপ্রশাসনের জনবল কাঠামোয় ৫০২টি অনুমোদিত যুগ্মসচিবের পদ রয়েছে।  পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ে এখন সরকারের যুগ্মসচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৮৮। এই পরিসংখ্যান বলছে, নিয়মিত পদের চেয়ে ৩৮৬ জন যুগ্মসচিব বেশি। ফলে এসব কর্মকর্তাকে পদোন্নতি পূর্বপদ অর্থাৎ যুগ্মসচিবকে উপসচিবের পদে বসে পূর্বের কাজ করতে হবে এবং যথা আসনেই বসতে হবে। কারণ উচ্চতর পদে বসার মতো জায়গাও নেই। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ আছে ১০৩টি। এর সঙ্গে সমপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে (নির্ধারিত পদের বাইরে অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় নিয়োগ) থাকা পদ আছে আরও ১২৫টির মতো। সব মিলিয়েও অতিরিক্ত সচিবের পদ দাঁড়ায় ২২৮টিতে। কিন্তু এখন কর্মরত অতিরিক্ত সচিব ছিলেন ৪১৪ জন। অর্থাৎ পদের চেয়ে ১৮৬ জন অতিরিক্ত সচিব বেশি।

বাংলাদেশ সচিবালয়। ছবি- সংগৃহীত

গত মঙ্গলবার উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৫৯ জন কর্মকর্তাকে। এর অধিকাংশকেই আগের পদে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশাসনে এখন উপসচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৯৩। এ পদে কার্যত নিয়মিত পদ আছে ৮৬২টি। অবশ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দাবি, সারা দেশে সমপর্যায়ের পদগুলো মিলিয়ে উপসচিব পদ আছে ১ হাজার ৭৫০টি।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ঊর্ধ্বতন নিয়োগ বদলি) মোহাম্মদ আব্দুস সবুর কথা প্রসঙ্গে বলেন, প্রতি বছর প্রশাসন অন্যান্য ক্যাডারের হাজার হাজার পদ সৃজন করে। কিন্তু প্রশাসনের জন্য কোনো পদ সৃজন করা হয় না। ধীরে ধীরে এদিকটাও নজর দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সচিবালয়। ছবি- সংগৃহীত

অচিরেই আবারও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। কারণ প্রথম দফায় যেসব কর্মকর্তার যুগ্মসচিব পদোন্নতি হয়েছিল তাদের তিন বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে আরও বেশি সময় তারা একই পদে চাকরি করছেন। পাশাপাশি ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও এখন তৎপর হচ্ছেন যুগ্ম সচিব হতে। তাদেরও উপসচিব হিসাবে তিন বছর কাল অতিক্রান্ত। সব মিলিয়ে পদোন্নতির ধাক্কায় প্রশাসন ক্রমশ শ্রী হারাচ্ছে। ভঙ্গুর দশা জনবল কাঠামো। 

এদিকে এবারের দুটি স্তরের পদোন্নতিতে যোগ্যতা ও আদর্শগত কোনো প্রশ্ন না থাকলেও বেশকিছু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে সুপাসিড করা হয়েছে। আবার ভিন্ন আদর্শ লালন করেন, এমনকি বিভাগীয় অভিযোগ থাকার পরেও তাদের পদোন্নতিতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। আবার যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তারা মিষ্টি মিঠাই নিয়ে সচিবালয়ে মন্ত্রী, সচিব ও সহকর্মীদের কক্ষে কক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।

সাবেক একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান থাকলেও তা এখন মানা হচ্ছে না। আবার পদও তৈরি করা হচ্ছে না। এটি অসম্ভব রকমের আইন বিরুদ্ধ কাজ। কারণ, পদের বিপরীতে কর্মকর্তার বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদান করা হয়। যেখানে পদই নেই সেখানে পদোন্নতি দেওয়া হলেও যারা পদ হারা থাকবেন তাদের বেতনভাতা দেওয়াও বেআইনি হবে। তার মতে, প্রশাসনে বড় ধরনের সংস্কারের তাগিদ দীর্ঘদিনের হলেও তা উপেক্ষিত থাকায় প্রশাসনে আজ চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

ইত্তেফাক/এমএএম