ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নারী শিক্ষার সূচনা হয়েছিল মূলত ব্রিটিশদের শাসনামলে। এসময় অন্তঃপুরে থাকা নারীরা সমাজ, সংসারের রক্তচক্ষু সামলে কলম ধরতে শুরু করেন। শুধু সাহিত্যে নয়, সাময়িকপত্র সম্পাদনার ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে আসতে শুরু করেন। নারী শিক্ষার আলো তখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এর পাশাপাশি শুরু হয় নারী জাগরণ।
বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, বাংলায় মেয়েদের স্কুল প্রথম চালু করেন মিশনারিরা। ১৮১৯ সালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ গঠন করে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ১৮২৪ সাল নাগাদ ঢাকায় মেয়েদের আরেকটি স্কুল চালু করা হয়। অবশ্য ১৮২৬ সালে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮২৮ সালের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ সময় শুরু হয় নারী শিক্ষা নিয়ে তর্ক বিতর্ক। ‘স্ত্রীলোকেরা বিদ্যাশিক্ষা করিলে বিধবা হয়’ হিন্দু সমাজ থেকে এই আপত্তি ওঠে। তারপরও ক্রমশ প্রসারিত হয় নারী শিক্ষা। নারীর উন্নতি সাধনে, তাদের জন্য পত্রপত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন প্রগতিশীলরা।
বাংলায় পত্রিকার জন্ম প্রায় ২০০ বছরের বেশি হবে। ১৮১৮ সালের শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’কে প্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়। তবে সেই ইতিহাসের প্রায় ৫০ বছর পর শুধু নারীদের জন্য প্রকাশ হয়েছে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা। এটি এখনকার সময়ের ম্যাগাজিন বা নারীদের ফ্যাশন নিয়ে ছোট্ট আর্টিকেলের কথা বলছি না। সময়টা আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগের। ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল বামাবোধিনী সভার উদ্যোগে। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ১৬ নম্বর রঘুনাথ চ্যাটুয্য স্ট্রীটের বাড়ির বামাবোধিনী সভার কার্যালয় থেকে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল। মূল্য ছিল মাত্র এক আনা। মুদ্রণ সংখ্যা ছিল এক হাজার। বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত। পত্রিকাটির বেশির ভাগ লেখক ছিলেন পুরুষ। অবশ্য নারীরাও তখন লিখতেন তবে বেশিরভাগ লেখিকা লিখতেন ‘গৃহবধু’ ছদ্মনামে।
বামাবোধিনী পত্রিকার সাত বছর পর ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে এসে প্রথম নারী সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘বঙ্গমহিলা’ প্রকাশ হয়। সম্পাদনা করেন কবি মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়। পরবর্তীতে প্রথম মাসিক জেন্ডারভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘অনাথিনী’ নারীদের দ্বারা পরিচালিত ও প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালের জুলাই মাসে। নারী কর্তৃক সম্পাদিত প্রথম সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘বঙ্গবাসিনী' প্রকাশ হয় ১৮৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। এছাড়াও ১৮৬৯ সালে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়-সম্পাদিত পাক্ষিক ‘অবলাবান্ধব’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য নারী পত্রিকা। নারীদের দিয়ে পরিচালিত বা সম্পাদিত না হয়েও নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে এবং সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে আরও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল। যেমন ‘হেমলতা’ (১৮৭৩); ‘অবলা হিতৈষিণী’ (১৮৭৪); ‘বঙ্গবালা’ (১৮৮৫); ‘সাবিত্রী’ (১৮৯৬) প্রভৃতি। এ সবই ছিল পুরুষ সম্পাদিত পত্রিকা। পরে আরও অনেক নারী পত্রিকা প্রকাশ হয় যার বেশির ভাগের স্থায়িত্ব খুব কম দিন ছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পূর্বপাকিস্তান হওয়ার কিছুকাল আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ ঢাকায় স্থানান্তরের পর এ দেশে নারী সম্পাদিত ও নারীদের জন্য প্রকাশিত পত্রপত্রিকার ধারার সূচনা হয়। ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। শুরুতে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, পরে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন এবং আমৃত্যু ‘বেগম’ পত্রিকার হাল ধরে জীবন পার করে দিয়েছেন তিনি। ‘বেগম’ পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকতায় নারী জাগরণের সূত্রপাত হয়। ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অসংখ্য নারী লেখক, সাংবাদিক তৈরি করেছেন।
১৯৪৯ সালে কবি জাহানারা আরজুকে নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল প্রকাশ করেন ‘সুলতানা’। এরপর পাবনা থেকে কুমারী জ্যোৎস্নারাণী দত্ত ও অনিমা গুপ্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মানসী’, মাহফুজা খাতুন সম্পাদিত ‘নওবাহার’, চৌধুরী জেবুন্নেছা বেগম সম্পাদিত ‘মাসিকপত্র’, জাহানারা ইমাম সম্পাদিত ‘খাওয়াতীন’, বেগম মুশতারি শফি সম্পাদিত ‘বান্ধবী’সহ আরও অনেক নারীদের পত্রিকা প্রকাশ হয়। কিন্তু এর অধিকাংশই ছিল ক্ষণস্থায়ী। নারী বিষয়ক পত্রিকার এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশ হয় পাক্ষিক ‘অনন্যা’। বর্তমানে নারীদের পত্রিকা হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে থাকার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ‘সানন্দা’(১৯৮৬) ও বাংলাদেশের ‘পাক্ষিক অনন্যা’(১৯৮৮)। প্রকাশনার প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত পাক্ষিক অনন্যা নারীদের কন্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
নিজের কণ্ঠস্বর প্রকাশের প্রবল আগ্রহ থেকেই ১৯৮৮ সালে তাসমিমা হোসেন ‘পাক্ষিক অনন্যা’ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। লক্ষ্য ছিলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার, যেখানে নারীর চোখে মানুষ বিশ্বটাকে দেখবে। অনন্যার মাস্টহেড ডিজাইন করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। প্রথম প্রচ্ছদ রচনা লেখেন ঔপন্যাসিক মকবুলা মনজুর। দাম ছিলো ৮ টাকা। সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে অনন্যা এগিয়েছে আপন গতিতে।
পাক্ষিক অনন্যা ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশের নারীদেরকে তাঁদের অসামান্য অবদানের জন্য বার্ষিক ভাবে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার দিয়ে আসছে। এই সম্মাননা প্রদানের শুরুর গল্পটিও বেশ নাটকীয়ই ছিল বলা যায়। ১৯৯৩ সালে যখন মৌলবাদীরা তসলিমা নাসরিনের মাথার মূল্য ৪০ হাজার টাকা ধার্য করল, তখন ‘অনন্যা’ সম্পাদক তাসমিমা হোসেন অবাক হয়ে ভাবলেন – ‘বাব্বা, বাংলাদেশের মেয়েদের তো অনেক দাম!’ তখন নিউজ উইক ম্যান অব দ্য ইয়ার ঘোষণা দিত। তখন তাঁর ভাবনায় এলো – উইমেন অব দ্য ইয়ার। তাসমিমা হোসেনের এই ভাবনা থেকেই অনন্যা শীর্ষ দশ-এর যাত্রা শুরু। এই আয়োজনের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশের নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মাননা প্রদান করে থাকে। ১৯৯৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অনন্যা শীর্ষদশ সম্মানিত করেছে ২৭০ জন কৃতি নারীকে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯ নভেম্বর ২০২২ শনিবার বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে হতে যাচ্ছে অনন্যা শীর্ষদশ ২০২১। এছাড়াও পাক্ষিক অনন্যা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর একজন কৃতী নারী-সাহিত্যিক অথবা সাহিত্য-গবেষককে ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার’ পুরস্কার প্রদান করে থাকে। ২০১৬ সালে অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেনের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘অনন্যা ফাউন্ডেশন’। সংস্থাটি সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এছাড়াও সুবিধাবঞ্চিত নারী, শিশু, শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে অনন্যা ফাউন্ডেশন।
ঐতিহ্যবাহী ম্যাগাজিনটি তরুণদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে গঠন করেছে তরুণ পাঠকদের সংগঠন ‘অনন্যা ১৮ প্রভা’। নারীর অধিকারের বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি, সমঅধিকার নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা, সৃজনশীল সংস্কৃতির চর্চা, ও ভবিষ্যৎমুখী উদ্যোগে উৎসাহী করে তোলা ও সমভাবাপন্ন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলাই ‘অনন্যা ১৮ প্রভা’র মূল উদ্দেশ্য।
অনন্যার জন্ম ১৯৮৮ ভয়ংকর বন্যাক্রান্ত সময়ে। কিন্তু দুর্যোগের মাঝে যাদের পথচলা, স্তব্ধতার বেড়াজালে আটকে থাকে কীভাবে। ২০২০ সালে করোনার মতো মহামারি পুরো বিশ্বকে যখন স্থবির করে দিয়েছিলো, নারীর জন্যে গড়ে তোলা নির্ভরযোগ্য এই প্লাটফর্মটি কিন্তু থেমে যায়নি। অনন্যা হেঁটেছে ভিন্ন পথে, পা রেখেছে অনলাইন সংস্করণে। ‘কাগজে যেমন ওয়েবেও ঠিক তেমন’ স্লোগান নিয়ে অনন্যা অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে। নতুন রুপে সেজে উঠে অনন্যা অনলাইন ভার্সন www.anannya.com.bd, প্রতিদিনের নারীভিত্তিক খবরের পাশাপাশি পাক্ষিক রুপে প্রকাশ হতে থাকে ই-ম্যাগাজিন। গড়ে উঠে ভার্চুয়ালি দেশ বিদেশের নারীদের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়ার নতুন প্ল্যাটফর্ম।
দীর্ঘ ৩৫ বছরের পথচলায় ‘অনন্যা’ ছিলো নারীর অন্যতম মুখ্যপত্র। নারীর সামাজিক, পারিবারিক, বৈশ্বিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে ছিলো সোচ্চার। বর্তমানে ‘অনন্যা নারীর কথা বলে’ ট্যাগলাইন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীদের এই পত্রিকাটি। ধরন হয়ত পাল্টেছে কিন্তু আচরণ পাল্টায়নি এক চুলও। অনন্যা নারীর কথা বলে যাচ্ছে তার চিরাচরিত নিয়মেই।
লেখকঃ গণমাধ্যম কর্মী