দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে আদালতের ‘অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা’র আওতায় থাকা জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের টানা ১৭ দিন পর আজ শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) প্রথম বারের মতো কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন এবং বক্তব্য রাখবেন।
জাপার পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) জানানো হয়েছে, দলের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বাদ আসর রাজধানীর আরমানিটোলায় আয়োজিত স্মরণসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ১৭ দিন ধরে চুপচাপ রয়েছেন জি এম কাদের। কোথাও কোনো বক্তব্য রাখেননি।
দলীয় কার্যক্রমেও অংশ নেননি। বনানী কার্যালয়ে মাঝেমধ্যে গেলেও দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কেবল গত ৬ নভেম্বর সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে ২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্য দিয়েছেন।
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ইত্তেফাককে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা থাকায় জিএম কাদের সাহেব পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না, কিন্তু রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। কারণ, রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারা সাংবিধানিক অধিকার। সে অনুযায়ী, তিনি পার্টি পরিচালনা করবেন, দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, এখন থেকে নিয়মিত বক্তব্য-বিবৃতিও দেবেন।’
জাপার সমন্বয় সভা ডাকা হয়েছে
পার্টি চেয়ারম্যানের ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে আজ শুক্রবার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ জাপা, দলের সকল অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসমূহের এবং ঢাকায় অবস্থানরত নেতাদের সমন্বয় সভা ডাকা হয়েছে। রাজধানীর কাকরাইলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠেয় এই সমন্বয় সভায় সভাপতিত্ব করবেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরতে পারেন রওশন
মাঝখানে কয়েক দিন বাদ দিয়ে টানা এক বছর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরতে পারেন। গত ২২ অক্টোবর তার দেশে ফেরার কথা থাকলেও তিনি ফিরেননি। এরপর তার অনুসারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২ নভেম্বর তিনি দেশে ফিরতে পারেন। তবে ফিরেননি। বর্তমানে তার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদ গতকাল ইত্তেফাককে জানান, আগামী সপ্তাহে রওশন এরশাদ দেশে ফিরতে পারেন, তবে তারিখ এখনো ঠিক হয়নি।
ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ হঠাৎ গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে জাপার দশম জাতীয় কাউন্সিল ডাকেন। আগামী ২৬ নভেম্বর তিনি এই কাউন্সিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিনই (১ অক্টোবর) ‘দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না’—এমন কারণ দেখিয়ে তার পরিবর্তে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। এনিয়ে জাপায় বিবাদ দেখা দেয়। এ অবস্থায় জিএম কাদেরকে ‘সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে স্পিকার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত ৩১ অক্টোবর থেকে সংসদ বর্জনের ঘোষণা দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। আগের দিন রাতে এই ঘোষণা দিলেও ‘স্পিকারের আশ্বাসে’ পরদিনই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে সংসদে ফিরেন জাপার এমপিরা। অন্যদিকে, আগের দিন রাতে রওশন এরশাদও ২৬ নভেম্বর ডাকা দলের কাউন্সিল স্থগিত করেন।
জি এম কাদেরকে বরইপাতা ও কবরের ছবি পাঠানোয় কাজী মামুনের বিরুদ্ধে মামলা, মোবাইল জব্দ
জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, বর্তমানে রওশন এরশাদের মুখপাত্র এবং ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী কাজী মামুনুর রশীদ গত ৫ জুলাই জি এম কাদেরকে তার মোবাইলে ‘জীবননাশের হুমকিসংবলিত’ বার্তা পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কাজী মামুনের মোবাইল থেকে জি এম কাদেরের মোবাইলে বরইগাছের পাতা দিয়ে পানি গরম করা হচ্ছে—এমন ভিডিওচিত্র পাঠানো হয়। কাজী মামুন একটি কবরের ছবিও পাঠান জি এম কাদেরকে। এ ঘটনায় গত ৭ জুলাই জি এম কাদেরের জীবননাশের হুমকির কথা জানিয়ে প্রথমে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বিরোধীদলীয় উপনেতার সহকারী একান্ত সচিব অ্যাডভোকেট মো. আবু তৈয়ব।
পরে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন আবু তৈয়ব। অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হতে আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের জন্য ট্রাইব্যুনালের বিচারক জি এম কাদের ও কাজী মামুনের মোবাইল ফোন ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ দেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির সাব ইন্সপেক্টর নুরুল গতকাল ইত্তেফাককে জানান, ইতোমধ্যে তিনি জিএম কাদের ও কাজী মামুনের সঙ্গে কথা বলেছেন। দুজনেরই সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। এখন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে। সবমিলিয়ে মামলাটি তদন্তাধীন।
তবে কাজী মামুন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমার মোবাইল ফোন আমার হাতেই আছে’। অভিযোগের বিষয়ে কাজী মামুন এর আগে ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘হ্যাঁ আমি কবরের ও বরইপাতা দিয়ে পানি গরম করার ছবি পাঠিয়েছি। এগুলো আমাকে মোবাইলে পাঠিয়েছেন আজিমপুর দরগাহ শরিফের পিরসাহেব। আমি সেটাই কাদের সাহেবকে ফরোয়ার্ড করেছি মাত্র। এখানে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ, প্রত্যেকেরই কবরের কথা স্মরণ করা উচিত, কবরকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। প্রত্যেক নামাজের পর কবরের কথা মনে করা উচিত। তাছাড়া আমি শুধু জি এম কাদের সাহেবকেই নয়, আমার পছন্দের আরও অনেককেই এটা ফরোয়ার্ড করেছি।’
কাজী মামুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বিদিশা
এদিকে, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী কাজী মামুনুর রশীদ এবং ট্রাস্টের সদস্য হিসেবে কাজ করা কাজী রুবায়েত হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন এরশাদপুত্র ও ট্রাস্টের একমাত্র সুবিধাভোগী এরিক এরশাদ। এরিক স্বাক্ষরিত এই আবেদন নিয়ে বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসায় দেখা করেছেন এরিকের মা বিদিশা।
অভিযোগে এরিক বলেছেন, ‘আমি একজন প্রতিবন্ধী। ট্রাস্টের প্রাক্তন চেয়ারম্যান কাজী মামুন ও বহিষ্কৃত সদস্য কাজী রুবায়েত হাসান একটি সিন্ডিকেট গঠন করে ট্রাস্টের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে। তাদেরকে ট্রাস্ট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও তারা দায়িত্ব ছাড়ছেন না। মামুন ও রুবায়েত আমাদেরকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। আমার মাকে দারোয়ান ও ড্রাইভারদের সামনে ১৪ হাত মাটির নিচে পুতে ফেলার হুমকি দেয়, ট্রাক চাপা দিয়ে মারতে চায়।’ আবেদনে এরিক তাকে ও তার মা বিদিশাকে বাঁচানোর আকুতি জানান। বিষয়টি দেখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে লিখিত নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরিকের অভিযোগের বিষয়ে কাজী মামুন ইত্তেফাককে বলেন, ‘এরিককে ভয় দেখিয়ে বিদিশা এসব করাচ্ছেন। সত্য একদিন প্রতিষ্ঠা হবে।’