মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

প্রচলিত শিরক ও কিছু কথা

আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৪১

শিরক ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ। একটি শিরকই ইমান, যাবতীয় সত্কর্ম নিষ্ফল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসুল) কিন্তু তোমার কাছে আর তোমাদের পূর্ববর্তীদের কাছে ওহি করা হয়েছে যে, তুমি যদি (আল্লাহর) শরিক স্থির কর, তাহলে তোমার কর্ম অবশ্য অবশ্যই নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সুরা যুমার: আয়াত ৬৫)। পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেমন সুরা বাকারা ২২, নিসা, ১১৬, মায়েদা ৭২, আনআম ৮৮।

আল্লামা রাবেগ ইস্পাহানি (রহ.) ‘মুফরাদাতে’ লিখেছেন, শিরকের অর্থ দুই স্বত্বাধিকারের সংমিশ্রণ, সমকক্ষ স্থীর করা ইত্যাদি। শিরক প্রধানত দুই প্রকার :১. শিরকে আকবর তথা বড় শিরক—এটা আবার চার প্রকার:ক. সত্তাগত অংশীদারত্ব,  খ. গুণাবলিতে শিরক,  গ. আইনগত অধিকারে কাউকে শরিক করা,  ঘ. ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা। ২. শিরকে আসগার বা ছোট শিরক—একে প্রকারভেদে সীমিত করা যায় না। তবে উল্লেখযোগ্য হলো :ক. কথাগত খ. কার্যগত ও গ. বস্তুগত শিরক। শক্তি-সক্ষমতায় অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রাণি বা দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তুকে মহান আল্লাহর সমকক্ষ স্থির ও কল্পনা করা শিরক। ক্ষতি, উপকার করা, দান ও দান না করার একক অধিকারী হওয়া একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। প্রার্থনা করা, ভয় করা, কোনো কিছুর আশা-ভরসা করা কেবল মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদি কেউ এমন সামর্থ্যকে অন্য কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, তবে তা-ই শিরক। বান্দার জন্য অপরিহার্য বিষয় হলো তাওহিদ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা। অন্যথায় শয়তানের খপ্পরে পড়ে ইমান ও সত্কর্মের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, সমাজে বহুল প্রচলিত কয়েকটি শিরকের বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে:

১. ওপরে আল্লাহ্ নিচে আপনি বলা :এমন কথায় মূলত বলা হয় ‘আপনি চাইলেই হয়...’, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। বরং ‘তিনি (আল্লাহ) যখন কোনো কিছু করতে ইচ্ছা করেন, কেবল বলেন ‘হও’, ফলে হয়ে যায়’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত :৮২)।

২. মালিক ভরসা :‘আল্লাহ’ তার মূল সত্তাগত (জাত) নাম। শব্দটির কোনো রূপান্তর, লিঙ্গান্তর নেই। মহান আল্লাহর নিরানব্বইটি গুণবাচক (সিফাতি) নাম রয়েছে। ‘আল মালিকু’ একটি গুণবাচক নাম। অথচ কেউ কেউ কথায় কথায় ‘মালিক ভরসা’ বলেন। ‘মালিক ভরসা’ উচ্চারণে হারিয়েছে মহান আল্লাহর মূল সত্তাগত (জাত) নাম।

৩. কুসংস্কারজনিত শিরক :ক. পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা জাহির, ১০ পারা বাতিন এমন বিশ্বাস (যা শিয়াদের মধ্যে প্রচলিত), খ. কলবে শায়েখ বা পিরের কল্পনা বা পিরের  চেহারা, আকৃতি ইত্যাদির মোরাকাবা-ধ্যান, গ. মুরশিদ কেবলা, পিরবাবাকে দূর থেকে ডাকা, ঘ. মৃত মুরশিদ, পিরের আগমন কল্পনায় ঘর সাজিয়ে রাখা, ঙ. আল্লাহ যা করান, তা-ই করি এমন বলা, চ. শিরকের গন্ধযুক্ত নাম সম্বোধন ও উপাধি, ছ. গায়রুল্লাহর নামে তথা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জিকির করা।

৪. অন্যান্য শিরক :আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো গায়েবি ক্ষমতায় বিশ্বাস করা,  জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্বাস করা, কবর ধোয়া পানির গুণ, মাজারের গিলাফের তাজিম, প্রাণীর ছবি, চিত্র, প্রতিকৃতি, মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদির প্রতি তাজিম, অগ্নিপূজা, মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো, পিরের বাড়ির বা আস্তানার খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল, মাছ ও কচ্ছপ ইত্যাদির প্রতি অন্ধ সম্মান প্রদর্শন, পির বা ওলি-আউলিয়াদের কবরের মাটি এবং সেখানে জ্বালানো মোম বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী মনে করা, বিপদে পড়লে জিন, ফেরেশতা, পির, ওলি-আউলিয়াদের ডাকা এবং মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনে বিশ্বাস করা, নবজাতকের হাতে চামড়ার চিকন তার বা তাগা বা গাছ বা এ ধরনের অন্য কোনো কিছু চুড়ির মতো করে বেঁধে দেওয়া, যাতে বিশ্বাস করা যে এর মাধ্যমে কোনো অশুভ রোগবালাই বা বদ জিন-ভূত স্পর্শ করতে পারবে না, নবজাত শিশুকে জিনের অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বাচ্চার কান ছিদ্র করা, বাচ্চার বালিশের নিচে জুতার টুকরা রাখা অথবা শিশুর মাথার চুল না কাটা, চোখ লাগা থেকে শিশুসন্তানকে রক্ষার জন্য শিশুর গলায় মাছের হাড়, শামুক ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা, কপালে কালো টিপ বা দাগ দেওয়া ইত্যাদি আমাদের সমাজে প্রচলিত শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য যেমন দোয়া করতে বলেছেন, তেমনি শিরকের গোনাহ থেকে মুক্তির দোয়াও শিখিয়েছেন। ইমাম বুখারি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আদাবুল মুফরাদে তা তুলে ধরেছেন—‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আলামু ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা লা আলামু। (আদাবুল মুফরাদ, মুসনাদে আহমাদ) অর্থ :‘হে আল্লাহ! আমি মনের অজান্তে আপনার সঙ্গে শিরক করা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই এবং মনের অজান্তে যদি (শিরক) হয়ে যায়, তার থেকে আপনার কাছে ক্ষমা চাই।’

শিরকবিহীন অপরাধ আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকে মাফ করে দিতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তার সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্য যত পাপ-তাপ আছে, তা যাকে ইচ্ছা (বিনা শাস্তিতেই) ক্ষমা করে দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করে, সে মহা অপরাধে অপরাধী হয়ে যায়।’ (সুরা :নিসা, আয়াত :৪৮) মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছোট-বড় শিরক থেকে রক্ষা করুন। কেননা, ‘নিশ্চয়ই শিরক হলো সবচেয়ে বড় অন্যায়’ (সুরা লুকমান, আয়াত:১৩)

(তথ্যসূত্র: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থ, ইসলামি বিশ্বকোষ, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম প্রভৃতি গ্রন্থ)

লেখকদ্বয়: যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর ও প্রধান শিক্ষক, সানরাইজ আইডিয়াল স্কুল, মধুপুর, টাঙ্গাইল

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন