পাহাড়, ঝরনা আর সাগর-এমন মানুষ হয়ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যাদের প্রকৃতির এই তিন সৌন্দর্য তাড়িত করে না। ভৌগোলিক আয়তনে ছোট হলেও কী নেই আমাদের এই সোনার বাংলায়! ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের কথা। তখনও শীতের আমেজ কাটেনি। হুট করেই বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা হলো শুক্র-শনিবারের বন্ধের সঙ্গে মিলিয়ে আরেকদিন ছুটি নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার।
গন্তব্য ঠিক হলো পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাফাখুম ঝরনা-যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা, পাহাড় আর ঝরনা। যেই কথা সেই কাজ। খোলা হলো মেসেঞ্জার গ্রুপ, আর শুরু হল যাবতীয় প্রস্তুতি। আসলে প্রস্তুতি বলতে মূলত বাসের টিকিট কাটা আর থাকার বন্দোবস্ত করা। রাতের বাসে করে ঢাকা থেকে বান্দরবান শহর, ভোরে ফোর হুইলার ছাদখোলা গাড়িতে চড়ে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে থানচি, আর তারপর ইঞ্জিনের ডিঙ্গি নৌকায় স্বচ্ছ পানির পাথুরে নদী পাড়ি দিয়ে বিকেলে আমরা পৌঁছে গেলাম রেমাক্রি। পরদিন এখান থেকেই পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম নাফাখুম। এমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ঘেরা পাথরের বুক চিরে বয়ে চলা ঝরনা দেখে গর্ব আর আনন্দে আমাদের হৃদয় ভরে গিয়েছিল। আমাদের খুশি আর আবেগ দেখে আমাদের গাইড বলল- ‘এ আর এমন কী, এর চেয়েও অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা এখানে আছে। ঐ যে গ্রুপটা দেখছেন, উনারা আমিয়াখুম যাবে’।
রাতে ইউটিউব ঘেঁটে দেখলাম, কথা সত্যি! সময় স্বল্পতার কারণে আমাদের দ্রুত ফিরতে হলেও আমরা ঠিক করলাম এরপর হাতে বেশি সময় নিয়ে আবার যাবো। পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিলাম, একসময় এই অপার নান্দনিক পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর নাম ছিল ‘ভীতি’ আর ‘আতংক’। অথচ বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পরেই দেশের সবচেয়ে বেশি পর্যটকের গন্তব্য হল পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখনকার বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ থেকে ২৫ বছর আগের গল্প হয়ত রূপকথা মনে হবে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য মাইলফলক অর্জিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাগ্রতা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে এইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পাহাড়ে ফিরে আসে স্বস্তি আর স্বাভাবিক জীবন। অবসান হয় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা সংঘাত আর অস্থিরতার- স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি’। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যে গুরুদায়িত্ব নিয়ে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন, সেই অসমাপ্ত কাজই যেন পূর্ণতা পায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। চুক্তির ধারাগুলো একে একে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। সমতলের সঙ্গে পাহাড়ও সামিল হয় দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির রজতজয়ন্তী উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আজকে যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এই চুক্তি বাস্তবায়নের পর্যালোচনার বিষয়টি চলে আসে। সর্বমোট ৭২টি ধারার এ চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৪৮টি ধারা এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে, আর বাকিগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ ও ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ গঠন; ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভূমি কমিশন গঠন; পার্বত্য বাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, পুনর্বাসন ও এ পর্যন্ত ৭২৫জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ; ১২ হাজারেরও অধিক প্রত্যাগত শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন; একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৪১টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার; পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ও চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন; তিনটি পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা; বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য অগ্রাধিকার ও কোটা সংরক্ষণ ইত্যাদি।
এখানে উল্লেখ্য যে, নামকাওয়াস্তে চুক্তি নয় বরঞ্চ সত্যিকার অর্থে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয় তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, আর তাই ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার মাত্র এক বছরের মাথায় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি মূলত তাঁর লক্ষ্যের প্রথম ধাপ অর্জন করেছিলেন। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি একদিকে যেমন চুক্তির কিছু ধারা দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন, তেমনি টেকসই পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে মাথায় রেখে কিছু ধারা বাস্তবায়নের জন্য ‘ধীরে-চলো’ নীতি গ্রহণ করেছেন। এই ‘ধীরে-চলো’ নীতির শেকড়ে ছিল বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন এবং পাহাড়ি ও মূলধারার জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি। এরই অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ খাতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর বিগত ২৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজসহ দেড় হাজারেরও অধিক সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। একই সময়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়। সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রায় ৫ হাজার ১৪৬ কিমি সড়ক ও শতাধিক ব্রিজ-কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। আর এরই ফলশ্রুতিতে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিকাশের ফলে পাহাড় ও সমতলের মানুষের মাঝে এক সহযোগিতা ও সৌহার্দের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাছাড়া উল্লেখিত সময়ে ২৪৬টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসা সেবামূলক ক্যাম্পিং এবং কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় নানাবিধ পদক্ষেপের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেক কাছাকাছি পৌঁছোতে পেরেছে। আর এইসব কার্যক্রমের কারণে নতুন প্রজন্মের পাহাড়িদের কাছে আস্থার আরেক নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে যে সমালোচনা নেই তা নয়। গঠনমূলক সমালোচনা সবসময়ই যেকোনো সমাজের বিকাশের জন্য স্বাস্থ্যকর। কিন্তু যখন তা হয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিংবা হীন রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার, তখন তা ভয়ংকর। তবে একথা বলতেই হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের জানাশোনা এখনও সীমিত। প্রয়োজন অনেক বেশি নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর গবেষণার। তাহলেই সম্ভব হবে ঘাটতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং দেশ ও জাতি গঠনে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখা।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সীমান্তবর্তী নানা অপতৎপরতা, দেশের অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদীদের নিরব উৎপাত এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অপরাধ প্রবণতা এই সবকিছুই পাহাড়ের শান্তি ও সম্প্রতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এমনকী রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি হতে পারে বাধাগ্রস্ত। ভুলে গেলে চলবে না, শান্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই এ বাস্তবতাকে স্মরণ রেখে সরকারের উচিত হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ২৫ বছরের অর্জনকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করা এবং বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে যেকোনো মূল্যে পাহাড়ে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে পাহাড়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
লেখক-
সহযোগী অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: [email protected]