শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার ঠেকানো নিয়ে শঙ্কা

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ২২:০০

বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার বাড়ছে। এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কিন্তু প্রশ্ন হলো ব্যাংকিং চ্যানেলে এই অর্থপাচার কি ঠেকানো সম্ভব নয়? সেটা ঠেকানোর দায়িত্ব কার?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাণিজ্যের নামে ব্যাংকিং চ্যানেলে যে অর্থ পাচার হয় তা চাইলে ঠেকানো সম্ভব। কারণ এটা দাম কম-বেশি দেখিয়ে করা হয়। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের প্রকৃত দাম জানা খুবই সহজ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এবিআর) এবং কাস্টমসের এগুলো দেখার কথা।

গভর্নরের স্বীকারোক্তি:

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন দুইদিন আগে ঢাকায় এক সেমিনারে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘এক লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস (আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানো) হয়েছে।’

গত জুলাই মাসে এমন আশ্চর্যজনক প্রায় ১০০টি ঋণপত্র (এলসি) বন্ধ করা হয়েছে হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইইউ) গত ১ নভেম্বর তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, ‘২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বেশি দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে।’ তারা সর্বশেষ এই ধরনের আট হাজার ৫৭১টি ঘটনা চিহ্নিত করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ফেব্রুয়ারিতে দুদক কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তৎকালীন দুদক সচিব আনোয়ার হোসেন জানান, পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আল মুসলিম গ্রুপের আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ১৭৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে।

গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ আছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। বিনিয়োগের মাধ্যমেও পাচার হয়। আর এই ধরনের অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে ব্যাংকিং চ্যানেলে।

বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের কৌশল:

বিশ্লেষকরা বলেন, কম রপ্তানি মূল্য (আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং বেশি আমদানি মূল্য (ওভার ইনভয়েসিং)  দেখিয়ে  বৈদেশিক বণিজ্যের নামে অর্থ পাচার হলো প্রধান কৌশল। এর বাইরে যত পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয় তার চেয়ে কম পণ্য আমদানি করেও অর্থ পাচার করা হয়।

ধরা যাক, কেউ বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানির জন্য এলসি খুললেন। কিন্তু বাস্তবে ওই পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এক লাখ ৫০ হাজার ডলার।তাহলে বাংলাদেশে আসবে এক লাখ ডলার। বাকি ৫০ হাজার ডলার দেশের বাইরে থেকে যাবে। এটা হলো আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার। আবার কেউ একটি গাড়ি আমদানির জন্য এক লাখ ৫০ হাজার  ডলারের এলসি খুললেন। কিন্তু গাড়ির বাস্তব দাম এক হাজার ডলার। কিন্তু আমদানি দাম বেশি দেখিয়ে ওই ব্যক্তি ৫০ হাজার ডলার দেশের বাইরে পাচার করে দিলেন।

আবার কেউ এক লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করার জন্য এলসি খুললেন। সেই পণ্যর কন্টেইনার আসলেও বাস্তবে ভেতরে পণ্য নেই। কিন্তু কাস্টমসকে ম্যানেজ করে পণ্য খালাসও দেখিয়ে ফেলললেন। এর মাধ্যমে পুরো টাকাটাই তিনি দেশের বাইরে পাচার করে দিলেন। আর এই পাচারের পুরোটাই হয় ব্যাংকিং চ্যানলে।

আর এই পদ্ধতিতে অর্থ পাচারের জন্য দেশি এবং আন্তর্জাতিক চক্রগুলো সহায়তা করে। বিনিয়োগের নামে বিদেশে অফসোর কোম্পানি খুলেও অর্থ পাচার করা হয়। যে প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগের কথা বলা হয় বাস্তবে সেটা হয়তো একটি কাগুজে কোম্পানি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব:

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ বলছে গত অর্থ বছরে(২০২১-২২) শতকরা ২০ থেকে ২০০ ভাগ অতিরিক্ত আমদানি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা তারা শনাক্ত করেছে। এই ধরনের সন্দেহজন লেনদেনের সংখ্যা গত অর্থ বছরে আট হাজার ৫৭১টি। এই লেনদেনের সংখ্যা তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি। তখন(২০২০-২১) এমন লেনদেন হয়েছে পাঁচ হাজার ২০৮টি।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাণিজ্যের নামে এমন সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে তিন হাজার ৬৭৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৫৭৩টি। এতে স্পষ্ট যে ব্যাংকিং চ্যানেলে অব্যাহতভাবে অর্থ পাচার বাড়ছে। আর গত অর্থ বছরের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে অর্থের পরিমাণ উল্লেখ না করলে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা।

পাচার ঠেকানো কি অসম্ভব, দায়িত্ব কার?

বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে এই অর্থ পাচার বহুদিন ধরেই চলছে বলে জানান যমুনা ব্যাংকর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) মো. নুরুল আমিন। তিনি বলেন, ‘এগুলো ঠেকানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা সেটা চাই কি না।’

তার কথা, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক, এলসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, এনবিআর, কাস্টমস চাইলেই এই অর্থ পাচার ঠেকাতে পারে। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম কত সেটা যে কেউ জানতে পারে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হলো তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দাম যাচাই করা। সেটা করলেই কোনটার দাম বেশি দেখানো হয়েছে কোনটার কম তা জানতে পারবে। সেখানে অস্বাভাবিক কিছু পেলে সন্দেহজনকদের আমদানি রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের নামেও অর্থ পাচার বন্ধ সম্ভব। কেওয়াইসি ( নো ইওর কাস্টমার) করলেই ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাগুলো জানতে পারবে প্রকৃতই বিনিয়োগের জন্য দেশের বাইরে অর্থ যাচ্ছে, না পাচার করা হচ্ছে। সেটা তো করা হয়না।’

তার কথা, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পাচার বেশি হচ্ছে বলে কথা বলছে। কিন্তু তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে?  এগুলো ধরার জন্য কোনো সিস্টেম চালু করছে কি না তা নিয়ে কিছু বলছেনা।’

বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন পর বিষয়টি স্বীকার করছে, অনুধাবন করছে এটা একটা ভালো দিক। কিন্তু  কথা ছাড়া কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা। চেষ্টা করলে বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে এই পাচার ঠেকানো সম্ভব। আমাদের দক্ষতার কিছুটা অভাব আছে সত্য, কিন্তু আন্তরিকতা বড় কথা।’

তিনি জানান, ‘আমদানির নামে এর আগে কন্টেইনার ভর্তি ইট এনে অর্থ পাচার করেছে। খালি কন্টেইনার এসেছে। কাস্টম ধরেনি। অর্থ পাচার হয়ে গেছে। কোন পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে কী দাম এটা জানা তো সহজ। এর কি কোনো মেকানিজম নাই? তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক, এনবিআর কি করছে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিনিয়োগ বোর্ড তারাও তো দেখতে পারে। এক্সপোর্ট ডেভেলপমন্ট ফান্ড দেওয়ার সময়ও এটা দেখা যায়। কিন্তু কেউ দেখছেনা। শুধু কথা বলছে। কয়েকদিন কথা বলার পর ধামাচাপা পড়ে যাবে।’

তার কথা, ‘হুন্ডির মাধ্যমেও পাচার রোধ করা সম্ভব। ভারত তো করছে। তারা পাচারকারীদের বাইরে থেকে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করছে। তাহলে আমরা পারছি না কেন? আসল কথা কতটা চাই তার ওপর নির্ভর করছে।’

(জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।)

ইত্তেফাক/এএএম