শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান কেন উচিৎ নয় ন্যাটোর?

আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:২১

গত সপ্তাহে রোমানিয়ার বুখারেস্টে ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আলোচ্যসূচিতে শীর্ষে ছিল। বাইডেন প্রশাসনের অনুরোধে, চীনও ন্যাটো আলোচনার কেন্দ্রে ছিল, বিশেষত এশিয়ার বৃহত্তম শক্তি সম্পর্কে জোটের অন্যান্য দেশের নড়বড়ে রোধ করতে। এশিয়ান টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাইডেন প্রশাসন কিছুটা সফল হয়েছে। মার্কিন ও ন্যাটো কর্মকর্তারা বৈঠকের পর জানিয়েছিলেন, তারা সরবরাহ চেইনের জন্য চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করবে। একইসঙ্গে বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রযুক্তি সম্পর্কিত অবরোধ আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে জানা গেছে।

চীনের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হওয়া সত্ত্বেও, এশিয়ার নিরাপত্তায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত ন্যাটোর জন্য একটি বড় ভুল হবে। এমন সংকটময় সময়ে ইউরোপের জন্য চীনের বড় মাথা ব্যথা হওয়া উচিত নয়। 

মার্কিন ও ন্যাটো কর্মকর্তা।

বিগত কয়েক বছরে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তিতে ন্যাটো যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ন্যাটো সদস্য দেশগুলো শি জিন পিংয়ের অধীনে চীনা পররাষ্ট্র নীতির দিক নির্দেশনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ওপর তার দখল শক্ত করে কয়েকদিন আগে তিনি তৃতীয় পাঁচ বছরের জন্য পুনর্নির্বাচিত হন।

ব্লকের বেশ কয়েকটি দেশ, যারা একসময় বিশ্বাস করেছিল যে বেইজিংয়ের সঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক অবশেষে চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও গণতান্ত্রিক করে তুলবে। এর মাধ্যমে চীনের জনগণের স্বাধীনতা আনা হবে। তারাও এখন স্বীকার করেছেন যে তাদের আশা কিছুটা 'সরল'।

বিগত কয়েক বছরে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তিতে ন্যাটো যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ন্যাটো ঐতিহ্যগতভাবে চীনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতে চায় না। তবে বেইজিং বিরোধী না হলেও, তারা চীনের বিষয়ে আরও সন্দেহজনক অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। 

২০১৯ সালে ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ চীনের উত্থানকে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি একটি সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু জোটের ২০২২ সালের কৌশলগত ধারণাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেইজিংয়ের 'জবরদস্তিমূলক নীতি' এবং পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

২০১৯ সালে ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ চীনের উত্থানকে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি একটি সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ন্যাটোর পরিকল্পনার মধ্যে চীন ইস্যুকে অগ্রাধিকার দেওয়া তাদের জন্য ব্যয়বহুল হবে। যদিও শি'র অধীনে সিসিপি আরও উচ্চাভিলাষী ও আক্রমণাত্মক। তারপরও চীনকে মোকাবেলার জন্য ন্যাটো কোনো আদর্শ জোট নয়।

প্রথমত, ন্যাটো একটি সংস্থা যা প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ও বর্তমান রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করা। চীনকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হুমকি থাকবে।

ন্যাটো একটি সংস্থা যা প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

উত্তর আটলান্টিক চুক্তির প্রস্তাবটি মূলত উত্তর আটলান্টিক এলাকায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটি উপায় হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। চীন জোটের পূর্বাঞ্চল থেকে আড়াই হাজার মাইলেরও বেশি দূরে রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) দ্বারা ন্যাটো সদস্যদের আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য সামরিক হুমকি ন্যূনতম।

দ্বিতীয়ত, ন্যাটোর এখনই ইউরোপের বাইরে চিন্তা করা উচিত নয় কারণ এই মুহূর্তে ইউরোপে একটি চলমান সংঘাত চলছে, ইউক্রেনের যুদ্ধ। এক বছরেরও কম সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ ইতিমধ্যেই বিগত ৭৫ বছরের ইতিহাসে মহাদেশটির জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ফল বয়ে এনেছে।

উত্তর আটলান্টিক চুক্তির প্রস্তাবটি মূলত উত্তর আটলান্টিক এলাকায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটি উপায় হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল।

মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মতে, ইউক্রেন ও রাশিয়া প্রত্যেকে কমপক্ষে এক লাখ হতাহতের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে যুদ্ধে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক অন্তর্ভুক্ত নয়।

কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে শান্তি আলোচনার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে। ফলস্বরূপ, যুদ্ধ সম্ভবত ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভালভাবে চলতে থাকবে। 

কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে শান্তি আলোচনার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে।
রাশিয়ানরা তাদের আক্রমণের হার আরও বাড়াতে পারে। কারণ ইউক্রেনের বাহিনী সক্রিয়ভাবে ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটা মাথায় রেখে ন্যাটোর উচিত এখন চীনকে তার এজেন্ডা থেকে দূরে রাখা।

জোটটি ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। যার মধ্যে রয়েছে অসম সামরিক অবদান, এই বছর ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছে। ফলে কিছু ধনী সদস্য তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যয় করতে আগ্রহ দেখায়নি।

এই বছর ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছে।

পরিশেষে, ন্যাটো নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই যে কোনো কৌশলগত সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে চীনকে রাখার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ন্যাটো এই পথে চলতে থাকলে বেইজিং স্থির থাকবে না। 

বিপরীতে, এশিয়ার দিকে ন্যাটোর স্থানান্তরিত কৌশলকে ভারসাম্যহীন করতে চীন সম্ভবত রাশিয়ার সঙ্গে তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব দ্বিগুণ করবে। এটি জোটের জন্য বেশ সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ইতোমধ্যেই সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা রয়েছে। 

এশিয়ার দিকে ন্যাটোর স্থানান্তরিত কৌশলকে ভারসাম্যহীন করতে চীন সম্ভবত রাশিয়ার সঙ্গে তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব দ্বিগুণ করবে।

খোদ ইউরোপের মধ্যেও ভিন্নমত হতে পারে, যা জোটকে আরও হুমকির মুখে ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ আর উস্কানি না দিয়ে বরং ন্যাটোর এই সমস্যাকে দমন করা। 

ন্যাটো ইতোমধ্যে অনেক কিছু নিয়ে ভাবছে। শেষ যেটা দরকার সেটা হল এর মূল মিশন থেকে বিভ্রান্ত না হওয়া। বিশেষ করে এমন মুহূর্তে যখন জোটটি আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

ইত্তেফাক/ডিএস