দৈনিক ইত্তেফাক ৭০ বছর বয়সে পা দিল। এত চড়াই-উতরাই পার হয়ে পত্রিকাটি এখনো টিকে আছে স্বমহিমায়, এ তো চাট্টিখানি কথা নয়! কিন্তু সভ্যতার যে নতুন সংকট শুরু হয়েছে, তা কতটা চিত্রায়িত করতে পারবে বা পারছে আজকের পত্রিকাগুলো? সে কথাই একটু আলোচনা করি।
‘দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এ রকম পরম প্রত্যয়দীপ্ত বাণী উচ্চারণ করেছিলেন ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনের দ্বিতীয় দিনে। এর মাস ছয়েক পরেই তিনি মর্ত্যভূমি থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। বিদ্যালয়বেলায়ও তিনি দুর্যোগের মায়ায় প্রবঞ্চিত হননি, তখনো নিত্যের জ্যোতিকে ধরে রেখেছেন আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে। রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠ নিয়ে আমরাও দৃঢ়চিত্তে সব ধরনের দুর্যোগের মোকাবিলা করতে পারি একান্ত অনায়াসে বা অল্পায়াসে।
দুর্যোগমুক্ত কোনো যুগ পৃথিবীতে কখনোই ছিল না। দুর্যোগবিহীন যুগ কোনোদিন আসবেও না। আবার প্রতি যুগেই যে মানুষ দুর্যোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, দুর্যোগের কবলমুক্ত হয়েই মানুষ বিজয়রথে ছুটে চলেছে যুগ থেকে যুগান্তরের অভিমুখে। ইতিহাস তো আমাদের এমন কথাই জানিয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুসারেই বর্তমান যুগেও আমাদের দেশ ও তথা সমগ্র দুনিয়াই নানা ধরনের দুর্যোগকবলিত। সেসব দুর্যোগের মায়ার আড়ালেও নিত্যের জ্যোতি ঝলমল করছে।
আজকের পৃথিবীতে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটেছে সর্বত্র। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের তাণ্ডব থেকে মুক্ত নয় কোনো দেশই। বিশ্বায়নের নাম করে পরাশক্তিগুলো হিংস্র নখরে ক্ষতবিক্ষত করে চলছে পুরো বিশ্বকে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতার চাবিকাঠিটি লুটপাটতন্ত্রীদের করায়ত্ত। নারীর প্রতি সহিংসতা ও জঘন্য অসদাচরণের যে নগ্ন প্রকাশ এখানে-ওখানে ঘটছে, তেমনটি আগেকার কোনো কালেই দেখা যায়নি বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ক্রমাগতই এ রকম আরো দুর্যোগের উদ্ভব ঘটে চলছে। তবু দুর্যোগই যে একান্ত সত্য নয়, দুর্যোগ প্রতিরোধের শক্তিও যে প্রবল প্রতাপে জেগে উঠে নতুন যুগের আগমনবার্তা ঘোষণা করছে, সে সত্য থেকেও তো আমরা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না।
একান্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে পারলেন, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকবে সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।
এ বিষয়টির উপলব্ধির জন্যই আবার ফিরে যাই রবীন্দ্র প্রসঙ্গে। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনে কবিগুরু তার জীবনের শেষ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক সেই ভাষণটি আজও সব সংকটের অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোকশিখারূপে দেদীপ্যমান। যে সময়ে ঐ ভাষণটি প্রদত্ত হয়েছিল, সে সময়ে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত এক দানব মহাতাণ্ডব সৃষ্টি করে মানবসভ্যতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল সেদিন। অচিরেই মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে—এমন দুর্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক অনেক মানবপ্রেমিক মনীষী। শঙ্কা রবীন্দ্রনাথের চিত্তকেও স্পর্শ করেছিল বইকি। কিন্তু তার সত্তা তো ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। সত্যকে তিনি অবলোকন করতেন অখণ্ড দৃষ্টিতে এবং সত্যের প্রতিটি খণ্ডাংশেও সেই অখণ্ডের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতেন।
সে কারণেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিজের মৃত্যুর প্রায় পূর্বক্ষণে সভ্যতার অচিন্তনীয় সংকটেরও ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল সংকট উত্তরণের শক্তিটি তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাই তিনি একান্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে পারলেন, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকবে সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। ...মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্তে থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহত্ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার পথে। মানুষ্যের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।
আমরাই-বা আজকের সংকটে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একেই চূড়ান্ত মনে করে এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অপরাধী হয়ে উঠব কেন? আমরা তো দেখেছি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে, সভ্যতাবিরোধ ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয় ঘটেছে, মানুষের সভ্যতা নতুনতর দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আর সে সবই করেছে মানুষ, অপরাজিত মানুষ। সেই মানুষ নিশ্চয়ই নিশ্চল হয়ে নেই এবং ভবিষ্যতেও নিশ্চল হয়ে থাকবে না।
দৈনিক ইত্তেফাকও নিশ্চল থাকবে না, এ বিশ্বাস আমি রাখতে চাই।
লেখক: শিক্ষাবিদ।