শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মেট্রোরেলে প্রথম যাত্রায় স্বপ্নপূরণের আবেগ

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৩

প্রয়োজনের চাইতে আবেগ ও ভালোবাসার টানে এসেছে মানুষ। এসেছে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। আগারগাঁও আর উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশন উপচে পড়েছিল মেট্রোরেলে চড়ার তীব্র আবেগ নিয়ে আসা মানুষের ঢল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ সুযোগ পেয়েছেন প্রথম দিন মেট্রোরেলে ওঠার, আবার কাউকে ফিরতে হয়েছে ভাঙা মন নিয়ে। তার পরও সবাই দেশের প্রথম মেট্রোরেল নিয়ে শুনিয়েছেন তাদের গর্বের কথা, ভালোবাসার কথা। সরকারকে সময়োপযোগী এই কাজ করার জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন অকুণ্ঠচিত্তে।

বলেছেন, উত্তরা থেকে রাজধানীর মূল অংশের যোগাযোগে যুগান্তকারী পদক্ষেপ এই মেট্রোরেল সংযোজন, যা রাজধানীবাসীর চলাচলে কমপক্ষে চার কর্মঘণ্টা বাঁচিয়ে দেবে। পাশাপাশি সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২ পর্যন্ত না চালিয়ে সকালে দুই ঘণ্টা আর বিকালে দুই ঘণ্টা করে চালানোর কথাও বলেছেন প্রতিদিন সড়কপথে উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজারে চলাচলকারী ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা। এতে আগামী বছর পুরোপুরি চালু হওয়ার আগেই এই পথে চলাচলকারী মানুষের যাতায়াতে মেট্রোরেল বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করবে বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা।

ছবি: আব্দুল গনি

গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করার পর গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সীমিত আকারে চলাচল শুরু করেছে মেট্রোরেল। সময় কমিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলা এই যানে চলাচলের অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছিল রাজধানীবাসী। অবশেষে সব অপেক্ষার পালা শেষে গতকাল থেকে সাধারণ মানুষের চলাচল শুরু হয় মেট্রোরেলের। সাধারণ মানুষের মনে এই দ্রুতযানকে ঘিরে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা। মেট্রোরেলের উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন থাকলেও আপাতত অন্য কোনো স্টেশনে থামছে না ট্রেন। এদিকে, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল চার ঘণ্টায় ৩ হাজার ৮৫৭ জন যাত্রী টিকিট কেটে মেট্রোরেলে চড়েছেন। আর  এই বাবদ ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬০ টাকা আয় হয়েছে। উল্লেখ্য, গতকাল প্রথম দিনে ১০টি ট্রেন চলাচল করেছে।

গতকাল ভোর ৫টার আগেই রামপুরা থেকে আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনের সামনে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ান পলাশ সরকার। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ফজরের নামাজও পড়েন এখানে আসার পরে। তিনি বললেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রথম দিন উঠতে পারিনি। মেট্রোরেলে প্রথম দিন চড়ার সুযোগ হারাতে চাইনি। তাই আগে থেকেই এখানে এসেছি।

বৃহস্পতিবার আগারগাঁও ও দিয়াবাড়ী স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, পলাশের মতো আরও হাজার হাজার মানুষ প্রথম দিনে মেট্রোরেলে চড়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে জড়ো হয়েছিলেন স্টেশনের সামনে। বেলা যত বেড়েছে, মানুষের লাইন ততই দীর্ঘ হয়েছে। নির্ধারিত সময় সকাল ৮টা থেকে ১০ মিনিট পর পর স্টেশন দুটি থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ট্রেন। পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো স্টপেজ না থাকার কারণে ১২ মিনিটেই গন্তব্যে পৌঁছেছে ট্রেন।

এছাড়া, দুপুর ১২টার পর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার যাত্রীকে ট্রেনে না চড়ার আফসোস নিয়ে ফিরতে হয়েছে ঘরে। যারা ট্রেনে চড়তে পেরেছেন, তারা ভেসেছেন আবেগের জোয়ারে। সামান্য কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ছাড়া যাত্রায় মানুষকে খুব একটা ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। আবার ট্রেন থেকে নামার পরই যাত্রীদের গন্তব্যে যাতায়াতের জন্য অপেক্ষায় ছিল মেট্রোরেল শাটল বাস। বিআরটিসির এই দ্বিতল বাসে যাত্রীরা তাদের গন্তব্যে সহজেই চলাচল করতে পেরেছেন।

এদিকে, ট্রেনে ওঠানামার জন্য প্ল্যাটফরমে যে গার্ড রেইল দেওয়া রয়েছে, এর প্রশংসা করলেন যাত্রীরা। যাদের বিভিন্ন দেশে মেট্রোরেলে চড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা বললেন, ‘ঢাকার মেট্রো সার্ভিসে ট্রেনে চড়া ও নামার যে ব্যবস্থাপনা, সেটা খুব নিরাপদ। কেননা, অনেকেই দ্রুতগতির ট্রেনের খুব কাছে চলে যায়, এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। সেটা এখানে হবে না। তাছাড়া, আমাদের কোচের দরজাগুলোও অনেক বড়। এ কারণে মানুষের ওঠানামার সময় গেটে ভিড় টেলে ঢুকতে হবে না।’

আজমপুরের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন আখতার উদ্দিন। তিনি প্রতিদিন শ্যাওড়াপাড়া থেকে উত্তরার আজমপুরে যাতায়াত করেন। তিনি বললেন, ‘আমার মতো যারা প্রতিদিনের যাত্রী, তাদের জন্য মেট্রোরেল আশীর্বাদের মতো। সময় যেমন বাঁচবে, তেমনি বাসে চলাচলের ধকল পোহাতে হবে না।’

প্রথম দিনেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইয়াজ, আবির ও রিদম—তিন বন্ধু এসেছেন ট্রেনে চড়তে। এর মধ্যে ফাইয়াজ নিয় ইয়র্কে একাধিকবার মেট্রোরেলে চড়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাইরের দেশের থেকে আমাদের দেশের মেট্রোরেল উন্নতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যদি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাহলে তা আমাদের যান্ত্রিক নগরীতে এটা মানুষের আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে।’

মেট্রোরেল নির্মাণের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইটাল থাইয়ের কস্টিং বিভাগের কর্মীরা এসেছিলেন তাদের বিভাগীয় প্রধান ট্রিন প্যাচের নেতৃত্বে মেট্রোরেলে চড়তে। গত ছয় বছর ধরে কাজ করছেন তারা। তাই তাদের আনন্দের মাত্রা যেন একটু বেশিই দেখা গেল। এই বিভাগের কর্মকর্তা রেনেসাঁ আলম জানান, ‘আমরা এ দিনটার অপেক্ষায় এত দিন ধরে কাজ করেছি। আজ তাই ট্রেনে চড়তে পেরে খুব আনন্দ লাগছে।’

মেট্রোরেল যাত্রীরা। ছবি: আব্দুল গনি।

এদিকে মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা শাবনাজ পারভীন বললেন, ‘মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য গত কয়েক বছর ধুলা, জ্যাম, ঘণ্টা পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থেকে কষ্ট সহ্য করেছি। আজ ট্রেনে চড়তে পেরে সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে।’ কর্মজীবী রাহুল রায়ের বাসা উত্তরার জসীম উদ্দিন মোড়ে। তিনি চাকরি করেন আগারগাঁও সমাজসেবা অফিসে। দিয়াবাড়ী স্টেশনে রাহুল বলেন, ‘যানজটের শহরে যথাসময়ে অফিসে পৌঁছানোর টেনশনে ভোররাতেই ঘুম থেকে উঠে যেতাম। অফিসের নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হতাম। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় সেই কষ্ট দূর হবে। এখন আধা ঘণ্টাতেই অফিসে পৌঁছাতে পারব। এই মেট্রোরেল আমাদের কত যে সুবিধা নিয়ে আসবে, তা বলে বোঝানো যাবে না।’ 

আগারগাঁও থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ী স্টেশনের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ টাকা। ম্যানুয়াল ও ডিজিটাল দুই পদ্ধতিতেই বিক্রি করা হচ্ছে টিকিট। তবে প্রথম দিন ডিজিটাল মেশিনে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় টিকিট কাটতে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের। তা দু-এক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। টিকিট কাটার পর যাত্রীদের স্টেশনে প্রবেশের জন্য গেটে টিকিট কার্ড পাঞ্চ করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায় গেট। এরপর ট্রেনে করে গন্তব্যস্থলে নেমে আবার গেটে কার্ড পাঞ্চ করলে খুলে যায় বহির্গমন গেট।

ট্রেনে না চড়ার আক্ষেপ নিয়ে ফিরেছেন হাজারো মানুষ :মেট্রোরেলে চড়ার জন্য সাতসকালেই এসে লাইনে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষ। বেলা পৌনে ১১টায় সেই লাইন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে ঠেকে। শত শত মানুষ লাইনে ছিলেন। কিন্তু প্রথম দিনে তাদের আর মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ হয়নি। শেষে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন তারা।

মেট্রোরেল যাত্রীরা। ছবি: আব্দুল গনি

এ প্রসঙ্গে আগারগাঁও স্টেশন ম্যানেজার মিশুক কুমার দে বলেন, এখনই পূর্ণাঙ্গভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। সেজন্যই স্টেশনের ভেতরে ও প্ল্যাটফরমে যাত্রী প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যখন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, তখন এসব সমস্যা থাকবে না। এদিকে, টিকিটের জন্য টাকা প্রবেশ করার পর তা মেশিনে আটকে যাওয়া প্রসঙ্গে উত্তরা উত্তরের স্টেশন ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, এসব মেশিন খুব স্পর্শকাতর, যা কিছুদিন আগে সচল করা হয়েছে। শুরুতে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে, তবে এসব সমস্যা দ্রুতই কাটানো সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।

মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক এম এন সিদ্দিক জানান, সকাল ৮টা থেকে মেট্রোরেল ছেড়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে। প্রথম দিকে কোনো স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে না। তিনি জানান, ‘আমাদের প্রত্যাশা হলো তিন মাস পরে, সেটি ২৬ মার্চও হতে পারে, আমরা ঐ দিন থেকে পূর্ণ অপারেশনে যাব। এই সময়ের মধ্যে মানুষ মেট্রোরেলে চড়ায় অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, এটা আমাদের বিশ্বাস। শুরুতে মেট্রোরেল পূর্ণাঙ্গ অপারেশনে যাচ্ছে না।

কার্ড হারিয়ে জরিমানা গুনলেন ইমরান :কার্ড হারিয়ে ১০০ টাকা জরিমানা গুনেছেন ইমরান হোসেন নোমান নামে এক যাত্রী। তিনি ঢাকা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র বলে দাবি করেছেন। বৃহস্পতিবার মেট্রোরেলের উত্তরা স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশনে আসার সময় স্টেশন থেকে কেনা কার্ডটি হারিয়ে ফেলেন। এ কারণে তাকে ৬০ টাকার টিকিটের জন্য ১০০ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিয়ে স্টেশনের ভেতর থেকে বাইরে আসেন তিনি। আগারগাঁও স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা রেজা বলেন, ‘কার্ড তৈরি করতে যে টাকা খরচ হয়েছে, আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে সেই পরিমাণ টাকা রাখছি। এক্ষেত্রে একক কার্ডধারী যাত্রীদের ১০০ টাকা করে জরিমানা করছি।’

ইত্তেফাক/এমএএম