রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন, সার্বভৌম এ দেশে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং তাদের সকল প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ। তাই জনপ্রতিনিধিদেরকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে জনস্বার্থকে। দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার পথে।
চলতি একাদশ সংসদের গতকাল শুরু হওয়া ২১তম এবং ইংরেজি নতুন বছর ২০২৩ সালের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে সংবিধান অনুযায়ী দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন। ভাষণের শুরুতে তিনি দেশবাসীকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে মূলত বিভিন্ন খাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরেন।
সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহণের পর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে সম্ভাষণ জানান। অধিবেশন কক্ষে রাষ্ট্রপতির প্রবেশের পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। স্পিকারের ডান পাশে রাখা লাল রঙের গদিসংবলিত চেয়ারে বসেন রাষ্ট্রপতি। পরে স্পিকারের অনুরোধে রাষ্ট্রপতি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পাঠ করেন। এ সময় তিনি তার মূল বক্তব্য পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পিকারকে অনুরোধ জানান।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার ভাষণে বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ-প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অতিবাহিত করছি। ২০২২ সাল আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জের বছর ছিল। সমগ্র বিশ্বই পার করছে এক কঠিন সময়। করোনা অতিমারি আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে। তারপরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বেড়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিবাচক। মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে হয়েছে ৬০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে।
তিনি বলেন, করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতিতে গতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। সরকারঘোষিত ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার কৃষি, গার্মেন্টসসহ ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের সরাসরি উপকারভোগী প্রায় ৭ কোটি ৩২ লাখ ব্যক্তি ও প্রায় ২ লাখ প্রতিষ্ঠান। সরকার কর্তৃক কৃষি উৎপাদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিগত অর্থবছরে মোট ১৫ হাজার ১৭২ দশমিক ৭৯ কোটি টাকা ভর্তুকি এবং ৩৯ হাজার কোটি টাকা সরল সুদে কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বিশেষ প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার বীজ, সার এবং কীটনাশক বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’—স্লোগান নিয়ে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র আওতায় ৫০ লাখ ১০ হাজারের অধিক নিম্ন-আয়ের পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল এবং ২৪ টাকা দরে পাঁচ কেজি আটা বিতরণ করছে। খোলাবাজারে খাদ্য বিক্রয় (ওএমএস) চালু আছে। এছাড়া, সরকার টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল সরবরাহ করছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে এবং বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ১৬ দশমিক ১৪ লাখ টন, যা সন্তোষজনক।
আবদুল হামিদ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’-এর আওতায় ৬৪টি জেলায় প্রায় ৫ হাজার ২৬৩ কিলোমিটার নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখননের কাজ চলছে। ফলে ১০৯টি ছোট নদী, ৫৩৩টি খাল ও ২৬টি জলাশয় পুনরুজ্জীবিত হবে।
তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে ছয়টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম উড়াল মেট্রোরেল চালু হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি এমআরটির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ-ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ স্লোগান বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ১০০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লাখ গ্রামীণ নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। সকল নারী উদ্যোক্তাকে ই-কমার্সে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস ‘লালসবুজ ডটকম’ এবং ‘ইজয়িতা’ চালু করা হয়েছে।
আবদুল হামিদ আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’—এ লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৯৭ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৫টি পরিবারের প্রায় ৩৫ লাখ গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির’ ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হওয়ায় অনগ্রসর পার্বত্য অঞ্চল জাতীয় উন্নয়নে সংযুক্ত হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে সৌহার্দ বিরাজ করছে এবং দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে।