বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

অতীত ভুলের কারণে বেকায়দায় জার্মানির শিল্পজগত

আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৪৯

সংকটে পড়লে মানুষ অনেক সময়ে আলস্য ঝেড়ে ফেলে অতীতের ভুল সংশোধন করে অগ্রসর হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় জার্মান শিল্প বাণিজ্য জগতও জ্বালানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কাটিয়ে নতুন পথ খুঁজছে। 

অনেক রাসায়নিক কোম্পানি যেন ছোটখাটো শহরের মতো। সেখানে কোটি কোটি কিলোওয়াট আওয়ার পরিমাণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। জার্মানির অর্থনীতি জগতে জ্বালানির চাহিদা বিশাল হলেও এর আগে জোগান কখনো এত কমে যায় নি।

ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় জার্মান শিল্প বাণিজ্য জগতও জ্বালানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কাটিয়ে নতুন পথ খুঁজছে। 

রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইস্পাত কারখানা, ভারি শিল্প, যন্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। জার্মানির শিল্প জগতের জ্বালানির এমন বিশাল খিদে মেটানো এমনিতেই কঠিন। তার উপর গ্যাস ও বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে রাসায়নিক শিল্পক্ষেত্র বড় সংকটের মুখে  পড়েছে। 

কেন্দ্রীয় রাসায়নিক শিল্প সংগঠনের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইয়োর্গ রোটারমেল এ বিষয়ে বলেন, 'বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য কখনো বিশাল দর হাঁকা হচ্ছে। ডিটারজেন্ট থেকে শুরু করে ওষুধপত্র, আঠা ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের এই বাড়তি বিশাল ব্যয় ক্রেতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। এ সবই রাসায়নিক উৎপাদনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। কমপক্ষে আগামী বছর থেকে সব রাসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা যাবে।'

রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইস্পাত কারখানা, ভারি শিল্প, যন্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

বিএএসএফ নামের রাসায়নিক কোম্পানির চাহিদা মেটাতে প্রায় অর্ধেক গ্যাস এতকাল রাশিয়া থেকে আসতো। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতেই সেই কোম্পানি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা গাজপ্রমের সঙ্গে মিলে লুডভিগ্সহাফেনে কোম্পানির সদর দপ্তর পর্যন্ত একটি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করেছিল। 

পোল্যান্ডের উপর দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত ইয়ামাল পাইপলাইনে আর্থিক বিনিয়োগ করেছিল সেই কোম্পানি। ২০০৮ সাল থেকে বিএএসএফ 'নর্ড স্ট্রিম ১' পাইপলাইন নির্মাণের কাজেও অংশ নিয়েছে। ফলে বেশ সস্তায় রাশিয়া থেকে গ্যাস আনা সম্ভব হয়েছে। 

বিএএসএফ নামের রাসায়নিক কোম্পানির চাহিদা মেটাতে প্রায় অর্ধেক গ্যাস এতকাল রাশিয়া থেকে আসতো।

জার্মান অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট মার্সেল ফ্রাচার মনে করেন, 'ক্রিমিয়া দখলের পরেও রাশিয়ার উপর নির্ভরতা বাড়ানো প্রথম ভুল। দ্বিতীয় ভুল হলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঢিলেমি। দশ বছর ধরে দক্ষতাসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও জার্মানি সেই পথে অগ্রসর হয় নি। এখন তার কুফল দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ জার্মানিতে আমাদের ভুলই এমন গভীর সংকট এবং অর্থনৈতিক কাঠামো বিপন্ন করে তোলার কারণ।'

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বিদ্যুতের উচ্চ মূল্যের কারণে জার্মানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও গ্যাস ব্যবহার করা হয়। প্রতি কিলোওয়াট আওয়ারের জন্য প্রায় ৩২ সেন্ট মাসুল দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্তরে একই পরিমাণ গ্যাসের গড় মূল্য ১২ সেন্ট। 

ক্রিমিয়া দখলের পরেও রাশিয়ার উপর নির্ভরতা বাড়ানো প্রথম ভুল।

মাঝারি মাপের রপ্তানি নির্ভর কোম্পানিগুলোর জন্য জ্বালানির উচ্চ মূল্য বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়েই জার্মানি অতীতে সব সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

দেশ হিসেবে জার্মানি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিপুল ফায়দা তুলেছে। কিন্তু সস্তার জ্বালানি ছাড়া বিশ্ব বাজারে জার্মানিতে তৈরি পণ্য অতিরিক্ত দামী হয়ে উঠছে। এমন সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কী? 

মাঝারি মাপের রপ্তানি নির্ভর কোম্পানিগুলোর জন্য জ্বালানির উচ্চ মূল্য বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে।

আইএনজি ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্স্টেন ব্রজেস্কি বলেন, 'জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি ত্যাগ করে বিকল্প জ্বালানি গ্রহণের প্রক্রিয়া অবশ্যই বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পাবার ও ইতিবাচক কিছু করে দেখানোর বিশাল সুযোগ। শিল্পভিত্তিক দেশ, ইঞ্জিনিয়ারদের দেশ হিসেবে আবার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ফিরে পেতে সেই প্রক্রিয়া আমাদের সাহায্য করতে পারবে এবং অবশ্যই করবে। টেকসই পদ্ধতি ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি অত্যন্ত জরুরি।'

জার্মানির কোম্পানিগুলোকে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি ও জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিনিয়োগের পাশাপাশি গবেষণা ও উন্নতির কাজে মদত দিতে হবে। রাষ্ট্রের তরফ থেকেও জ্বালানির নেটওয়ার্ক ও অবকাঠামো জরুরি ভিত্তিতে সম্প্রসারণ করতে হবে।

ইত্তেফাক/ডিএস