মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কংগ্রেসে হামলার ঘটনায় ব্রাজিলজুড়ে চলছে গণগ্রেফতার

আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৫৪

ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর সমর্থকরা দেশটির কংগ্রেস, প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস এবং সুপ্রিম কোর্টে হামলা চালানোর ঘটনায় ১৫ শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা শপথ নেয়ার এক সপ্তাহ পর এই দাঙ্গা হলো।

তিনি এই ঘটনাকে 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড' বলে উল্লেখ করেছেন এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। বলসোনারো গত অক্টোবরের নির্বাচনের হারকে মেনে নেননি এবং তিনি গত পহেলা জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর না করেই যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন।

ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর সমর্থকরা দেশটির কংগ্রেস, প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস এবং সুপ্রিম কোর্টে হামলা চালানোর ঘটনায় ১৫ শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সোমবার (৯ জানুয়ারি) পেটের ব্যথার কারণে তাকে ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমর্থনে এখন ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোর রাস্তায় বিক্ষোভ করছে হাজার হাজার মানুষ।

সাও পাওলো থেকে বিবিসির কেটি ওয়াটসন তার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, এই বিক্ষোভে মানুষের অংশগ্রহণ বেশ ভাল ছিলো, ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাস্তা পাওলিস্তা অ্যাভিনিউয়ের একটি অংশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। 

সোমবার (৯ জানুয়ারি) পেটের ব্যথার কারণে তাকে ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা ওই রাস্তাটি বন্ধ করে গান গাইছে, নাচছে ও ন্যায়ের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে। তবে সেখানেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আশঙ্কায় প্রচুর পুলিশের উপস্থিতি ছিল। এক পর্যায়ে গিয়ে পরিস্থিতি বেশ উত্তেজনাকর হয়ে পড়ে বলে বিবিসির সংবাদদাতা জানান। 

নতুন প্রেসিডেন্ট যিনি লুলা নামেই বেশি পরিচিত তিনি এবং কংগ্রেস ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধানরা জানিয়েছেন, তারা রোববারের (৮ জানুয়ারি) দাঙ্গার সময় 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং অপরাধমূলক ও অভ্যুত্থান প্রবণ ভাঙচুরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন'।

বিক্ষোভকারীরা ওই রাস্তাটি বন্ধ করে গান গাইছে, নাচছে ও ন্যায়ের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে

নাটকীয় দৃশ্যে দেখা গেছে, হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ব্রাজিল ফুটবলের হলুদ শার্ট ও পতাকা পরে পুলিশকে উপেক্ষা করে ব্রাজিলের প্রাণকেন্দ্রে লুটপাট করছে। এমন পরিস্থিতিতে লুলা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হন।

সোমবার সকালে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত নিরাপত্তা বাহিনী কর্মীরা ব্রাসিলিয়াতে বলসোনারোর সমর্থকদের করা একটি শিবির ভেঙে ফেলে। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে সারা দেশে সেনা ব্যারাকের বাইরে স্থাপন করা শিবিরগুলোর মধ্যে একটি এটি।

হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ব্রাজিল ফুটবলের হলুদ শার্ট ও পতাকা পরে পুলিশকে উপেক্ষা করে ব্রাজিলের প্রাণকেন্দ্রে লুটপাট করছে।

কর্তৃপক্ষ সোমবার ১২শ মানুষকে গ্রেফতার করেছে। এর আগের দিন আরও তিন শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। আইনমন্ত্রী ফ্লাবিও দিনো জানান, বিক্ষোভকারীদের বহন করে রাজধানীতে নিয়ে আসা প্রায় ৪০টি বাস জব্দ করা হয়েছে।

ব্রাসিলিয়া থেকে রিপোর্ট করা বিবিসির প্রতিবেদক বার্নড ডেবুশমান জানান, কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করলেও সোমবার বিকেল পর্যন্ত মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। ভবনের বাইরের দিকের জানালার ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করছিলেন কর্মীরা। 

আইনমন্ত্রী ফ্লাবিও দিনো জানান, বিক্ষোভকারীদের বহন করে রাজধানীতে নিয়ে আসা প্রায় ৪০টি বাস জব্দ করা হয়েছে।

ভবনের নিচ তলার প্রায় প্রতিটি জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলা হয়েছে। যার কারণে প্রতিটি জানালার কাঁচ প্রতিস্থাপন করতে হচ্ছে মেরামতকারী কর্মীদের। প্যালেসের বাইরের ফুটপাতেও বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দেখা গেছে। দাঙ্গাকারীরা বেশ বড় আকারে ভাঙচুর চালিয়েছে সেখানেও। 

এক কর্মকর্তা জানান, তারা কাঁচ ভাঙতে পাথরকেই ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ব্যবহার করছিলো। পাশের কংগ্রেস ভবনে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে মহামূল্যবান শিল্পকর্ম। যার মধ্যে স্বনামধন্য অনেক শিল্পকর্ম পানি দিয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে অথবা সেগুলোর মুখায়বব বিকৃত করা হয়েছে।

ভবনের নিচ তলার প্রায় প্রতিটি জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলা হয়েছে।

বিবিসির প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, রাস্তাগুলো বেশ শান্তই ছিল এবং তেমন কোন পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি নজরে আসেনি। বলসোনারো এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দাঙ্গা শুরু হওয়ার ছয় ঘণ্টা পর এক টুইটার পোস্টে তিনি দাঙ্গাকারীদের উস্কানি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এরমধ্যে ব্রাসিলিয়ার গভর্নর ইবানিস রোচাকে তার পদ থেকে ৯০ দিনের জন্য সরিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আইন মন্ত্রী আলেহান্দ্রে ডি মোরেস তার বিরুদ্ধে দাঙ্গা রুখতে ব্যর্থ হওয়ার এবং হামলার সময় 'বেদনাদায়কভাবে নীরব' থাকার অভিযোগ এনেছেন। রোচা রোববারের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।

ব্রাসিলিয়ার গভর্নর ইবানিস রোচা

ব্রাজিলের সংবাদ মাধ্যম ও গ্লোবো একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যায়, কয়েকজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বিক্ষোভকারীদের কংগ্রেস দখলের সময় হাসছেন এবং তাদের পেছনে রেখে ছবি তুলছেন। সাংবাদিকরা বিক্ষোভকারীদের জিজ্ঞেস করলে তারা খুব দ্রুত তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়।

লিমা নামে ২৭ বছর বয়স একজন প্রযোজনা প্রকৌশলী বলেন, 'এই জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের পর আমাদের আবার শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি এখানে ইতিহাসের জন্য এসেছি, আমার কন্যার জন্য এসেছি।'

কয়েকজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বিক্ষোভকারীদের কংগ্রেস দখলের সময় হাসছেন এবং তাদের পেছনে রেখে ছবি তুলছেন।

রাজধানীর অন্য বাসিন্দারা এই সহিংসতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন যে এটি দেশের জন্য একটি দুঃখজনক দিন।

দানিয়েল লাসের্ডা নামে ২১ বছর বয়সী একজন বিবিসিকে বলেন, 'আমি বলসোনারোকে ভোট দিয়েছি কিন্তু তারা যেটা করছে তা আমি সমর্থন করি না। আপনি যদি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সহমত না হন তাহলে সেটি জানিয়ে দিয়ে আপনার নিজের মতো চলা উচিত। এভাবে বিক্ষোভ করে এবং তাদের মতো এমন সহিসংতা করা উচিত নয়।'

বলসোনারোর সমর্থকরা ব্রাজিলজুড়ে শিবির স্থাপন করেছে।

বলসোনারোর সমর্থকরা ব্রাজিলজুড়ে শিবির স্থাপন করেছে এবং এদের মধ্যে কিছু সামরিক ব্যারাকের বাইরে স্থাপন করা হয়েছে। কারণ তার অতি উৎসাহী সমর্থকরা সেনা হস্তক্ষেপ চায় এবং তাদের মতে চুরি হয়ে যাওয়া নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠানের দাবি করে তারা।

ধারণা করা হচ্ছিলো, লুলার ক্ষমতা গ্রহণ তাদের আন্দোলনকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। ব্রাসিলিয়ায় সব ধরণের শিবির ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং শপথের দিন কোন হাঙ্গামা হয়নি। তবে রোববারের অবস্থা বুঝিয়ে দিয়েছে, আগের সব ধারণা অপরিপক্ব ছিল।

লুলার ক্ষমতা গ্রহণ তাদের আন্দোলনকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

কিছু বিক্ষোভকারী শুধু বলসোনারোর নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কারণেই রাগান্বিত নয় বরং তারা চায় লুলা যাতে কারাগারে ফিরে যান। ২০১৭ সালে দুর্নীতির জন্য তিনি ১৮ মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাকে নয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়।

বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কেরা রোববারের সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর নেতারা সোমবার এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। তারা ব্রাজিলের গণতন্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের উপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।

কিছু বিক্ষোভকারী শুধু বলসোনারোর নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কারণেই রাগান্বিত নয় বরং তারা চায় লুলা যাতে কারাগারে ফিরে যান।

এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, সোমবার বিকেলে লুলার সঙ্গে এক ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্রাজিলের গণতন্ত্রের জন্য অটুট সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ওয়াশিংটন সফরের বাইডেনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন ব্রাজিলের নেতা। 

২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের হামলার সঙ্গে ব্রাজিলের এই হামলার তুলনা করা হচ্ছে। বলসোনারো ট্রাম্পের একজন মিত্র। ওই দিনও ট্রাম্পকে সে বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন বাইডেন।

সুত্রঃ বিবিসি

ইত্তেফাক/ডিএস