টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি না পেলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট দশ সংগঠন নেতারা।
তারা বলেছেন, ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে দেশের স্বাধীনতার পূর্ণতা ও সমৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে বন্ধ থাকা জাহাজ চলাচল শুরু হলে পর্যটনে যুক্ত পাঁচ লাখ মানুষের পরিবারে আজ আনন্দের প্রত্যাবর্তন হতো। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন, সেন্টমার্টিন-টেকনাফ ও কক্সবাজারে পর্যটনে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের বাঁচান। তা না হলে আমরা অনশনসহ কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।
নাব্যতা সংকটের অজুহাতে বন্ধ থাকা 'টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে' পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল দাবিতে মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টদের ১০টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টের হোটেল মিশুকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজার ভ্রমণকারী পর্যটকদের সিংহভাগই সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেন। সেন্টমার্টিন মূল ভূখণ্ডের ১৫ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান। সমুদ্র পথে যাতায়াত সহজসাধ্য করতে প্রতি নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটন মৌসুমে পর্যটক বহনে জাহাজ চলাচল করে। পর্যটক ভ্রমণসেবা দানের মাধ্যমে ট্যুর অপারেটরদের পাশাপাশি ট্যুর গাইড, হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউজ, রেস্টহাউজ, ফ্ল্যাট ও কটেজ ব্যবসায়ি- কর্মচারি, বাস-মিনিবাস ব্যবসায়ি-কর্মচারি, রেস্টুরেন্ট ও ফুড প্রসেসিং ব্যবসায়ি-কর্মচারি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, ভ্যান- রিক্সা-টমটম চালক ও বিভিন্ন কুটির শিল্প ব্যবসায়িসহ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
কিন্তু নাফনদীতে নাব্যতা সংকটের অজুহাতে চলতি পর্যটন মৌসুমের শুরু থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে পর্যটকবাহি জাহাজ বন্ধ আছে। তবে, মিয়ানমারের মালামাল পরিবহন চলমান। চলাচলে অতি গভীরতা দরকার পড়া দুটি জাহাজ গত তিনদিন আগে এসে মাল খালাসের জন্য নাফনদীর টেকনাফ বন্দরে এখনো নোঙ্গর করে আছে। নাব্যতার সংকটই যদি থাকতো তাহলে মালবাহী মিয়ানমারের এসব জাহাজ মালামাল নিয়ে কিভাবে আসা-যাওয়া করছে? মাসে একাধিক জাহাজ বাণিজ্যিক মালামাল নিয়ে এখানে আসে বলে জানিয়েছেন সিএনএফ এজেন্ট ও বন্দর সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে পর্যটকবাহি জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় পর্যটন সেবায় যুক্ত ৫ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন। এসব মানুষের জীবিকার স্বার্থে এ নৌ-রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতির ব্যবস্থা করতে পর্যটন প্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িরা বলেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকলেও পর্যটক যাতায়াত কিন্তু বন্ধ নেই। ভ্রমণপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঠের বা স্পিড বোটে সেন্টমার্টিন-টেকনাফ যাতায়াত করছে। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তবে সমগ্র পর্যটন শিল্পের ওপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে নতুন বিনিয়োগ হারাবে পর্যটন শিল্প এবং বিদ্যমান বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়বে। তখন আর্থিক অনটনে নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে কর্মহীন মানুষগুলো। যা এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবক্ষয় বয়ে আনবে। এসব বিষয় বিবেচনায় পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও জীবিকায়নে প্রত্যাবর্তনে অতিদ্রুত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চালু করা হোক।
তারা আরও বলেন, পর্যটক ভ্রমণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে বলে বেশ কয়েক বছর ধরে সেন্টমার্টিন নিয়ে নানা অপপ্রচার চলছে। কিন্তু পরিবেশ এমন একটি মাধ্যম যা আমাদের পারিপার্শ্বিকতা তৈরি এবং বাঁচার ক্ষমতা দেয়। আমাদের চারপাশে যা কিছু- সব মিলিয়েই আমাদের পরিবেশ। মানুষকে বাদ দিয়ে পরিবেশ না হলেও মানুষই পরিবেশ ধ্বংস করছে এটাও সত্য। পর্যটন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের স্বার্থেই সেন্টমাটিনের পরিবেশ রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে টুয়াক ইউএনডিপির সহায়তায় জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সেন্টমার্টিনকে প্লাষ্টিকমুক্ত করতে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টদের পরিসংখ্যান মতে, গত ২০১৯ সালে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ৬০ হাজার ৫০০ জন পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেছেন। এ ১৫১ দিনের পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৬৩ জন মানুষ সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেছে। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের লোক সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। সেসব মানুষের সাথে অতিরিক্ত এক হাজার মানুষ বেশি অবস্থান করলে সেন্টমার্টিনের প্রতিবেশ-পরিবেশের এমন কি ক্ষতি হচ্ছে আমাদের বোধে আসছে না। সবকিছু বিবেচনার অনুরোধ করছি আমরা। নয়তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে জীবিকায়নের স্বার্থে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে পর্যটনসেবি সব সংগঠন পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।
ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েমন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সমন্বয়ে সী-ক্রোজ অপারেটর অনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (স্কায়াব), কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতি, সেন্টমাটিন আবাসিক হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতি, সেন্টমাটিন বোট মালিক সমিতি, ট্যুর গাইড এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার, কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেষ্টহাউজ মালিক সমিতি, বাংলাদেশ রেস্তোরা মালিক সমিতি, কক্সবাজার জেলা, কক্সবাজার বাস-মিনিবাস মালিক গ্রুপ, সেন্টমার্টিন রোস্তোরা মালিক সমিতি, সেন্টমার্টিন বাজার মালিক সমিতি যৌথভাবে এ দাবি করেন।
এসময় টুয়াক সভাপতি আনোয়ার কামাল, সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মনিবুর রহমান টিটু, রেস্তুরা মালিক সমিতি সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুল, সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ডালিম, স্কোয়াব সহসভাপতি এস এম আবু নোমান, ছৈয়দুল হক কোম্পানি, হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ, মেরিন ড্রাইভ হোটেল সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান, সেন্টমার্টিন হোটেল ও বাজার সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান, সেক্রেটারি এম এ রহিম জিহাদি, সেন্টমার্টিন বোট মালিক সমিতির সভাপতি রশিদ আহমদ, সাধারণ সম্পাদক হাবিবর রহমান, ট্যুর গাইড এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার সভাপতি শাহ আলম ও টুয়াক উপদেষ্টা কামরুল ইসলাম বক্তব্য দেন।
উল্লেখ্য, চলতি পর্যটন মৌসুমের শুরুতে গত বছরের ৬ অক্টোবর সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক সৈকত দিয়ে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলের সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন টুয়াকসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেই থেকে বিষয়টি কেবল বিবেচনাধীন বলে উল্লেখ করে আসছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ও বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সমন্বয়ক মো. আবু সুফিয়ান। কিন্তু মৌসুম শেষ হবার প্রক্রিয়া চললেও সেই দাবি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ফলে, পর্যটন ব্যবসায়ীরা মৃয়মান অবস্থায় রয়েছেন।