নতুন বছরকে আনন্দ-উৎসবে বরণ করে নেওয়ার রীতি সেই প্রাচীনকালের। পৃথিবীর প্রাচীনতম সর্বজনীন উত্সবগুলোর অন্যতম এই নববর্ষ উদযাপন। পণ্ডিতদের মতে, এই রীতি প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন ব্যাবিলনে যেদিন সূর্যের আলো-অন্ধকার সমান, অর্থাত্ দিন ও রাত একই সমান তাকে ‘ভার্নাল একুইনোক্স’ বলা হতো, এমন দিনটির পর প্রথম পূর্ণচন্দ্র দৃশ্যমান হওয়ার দিনকে ধরা হতো নতুন বছরের শুরু হিসেবে। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ১১ দিন ধরে উত্সব চলত। যার নাম ছিল আকিতু।
রোমানরা বছরের প্রথম দিনটি উদযাপন করে দেবতা জানুসের উপাসনা ক’রে। দেবতা জানুসের প্রতি মূল্যবান সামগ্রী উত্সর্গ করে, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সঙ্গে উপহার বিনিময় করে, এবং সেইসঙ্গে নানা ভোজসভা আয়োজন করে। একটি পুরনো বছরের শেষ, একটি নতুন বছরের শুরু। এদিন পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরের সামনের দিনগুলো ভালো কাটানোর প্রত্যয় তৈরি করে। ‘শুরু’ ও ‘শেষ’-এর রোমান দেবতা জানুসের (Janus) নাম থেকে এই জানুয়ারি মাসের উত্পত্তি। জানুসকে কল্পনা করা হয় দুই মুখমণ্ডলের সঙ্গে, যার এক মুখ অতীতের দিকে, আরেক মুখ ভবিষ্যতের দিকে। অতীত ও ভবিষ্যতের এই সংমিশ্রণের কারণেই মূলত জানুসকে বলা হয় সময়ের দেবতা। জানুসকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে কয়েক ধরনের মিথ। সবচেয়ে জনপ্রিয় মিথে বলা হয়, বনদেবী ক্রেনের সঙ্গে জানুসের প্রেমের গল্পকথা। দেবী ক্রেন তার প্রেমিকদের সঙ্গে ছলনা করে পাহাড়ের গুহায় নিয়ে যেত, এরপর সেখানে বন্দি করে রেখে দিত। জানুসের সঙ্গেও একই কাজ করতে গিয়ে জানুসের দু’মুখো মাথার কারণে ধরা পড়ে ক্রেন। পেছন চোখ দিয়ে দেখে ফেলে জানুস, আটকে ফেলে কার্ডিয়াকে।
অন্য একটি জনপ্রিয় মিথের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রোম সৃষ্টির ঘটনা। খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দে রাজা ন্যুমিতরা শাসন করছিলেন আলবালঙ্গা রাজ্য। ক্ষমতা দখল নিয়ে রাজার ছোটভাই আমিলুয়াস রাজাকে বন্দি ক’রে সিংহাসন দখল করে নেয়। ধর্মসম্মতভাবে সিংহাসনের কোনো উত্তরাধিকারী যেন না থাকে, সে উদ্দেশ্যে আমিলুয়াস বড়ভাই রাজা ন্যুমিতরার একমাত্র মেয়ে কুমারী সিলভিয়াকে সন্ন্যাসিনী হতে বাধ্য করে। সিলভিয়া কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার শৃঙ্খলে আটকে থাকতে চায়নি। তার ইচ্ছের সাড়া দেয় দেবতা মার্শ। অরণ্যের মাঝে মানুষ আর দেবতার প্রেমজ সংসর্গ ঘটে, জমজ পুত্রসন্তানের জননী হয় কুমারী সিলভিয়া। ঘটনাটি জেনে ফেলে আমিলুয়াস, সে সিলভিয়াকে বন্দি করে তার সন্তানদের হত্যার নির্দেশ দেয়। সিলভিয়ার বিশ্বস্ত ভৃত্যরা শিশু দুটিকে একটি ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়ে ভাসিয়ে দেয় টাইবার নদীতে। স্রোতের টানে শিশু দুটি ভেসে যায় দূরের এক জঙ্গলের কাছে। সেখান থেকে শিশু দুটিকে উদ্ধার করে একটি মাদি নেকড়ে। শিশু দুটি বেড়ে ওঠে সেই নেকড়ের দুগ্ধ পান করে। ধীরে ধীরে শিশু দুটি বড় হয়। তারা পরিচিত হয়ে ওঠে রেম্যু ও রম্যুলাস নামে। পেশা হিসেবে তারা বেছে নেয় মেষ পালন। দুই ভাই তাদের বন্ধু আর অনুসারীদের নিয়ে নতুন রাজ্য গড়ে তোলার জন্য যাত্রা শুরু করে অজানার উদ্দেশে। কোথায় নতুন রাজ্য হবে আর কে হবে তার রাজা, এই নিয়ে এবারে দুই ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় বিবাদ। তারপর দুই ভাই মিলে নেয় বিচিত্র এক সিদ্ধান্ত। পর দিন সকালে সবচেয়ে বেশি পাখি আসবে যার নজরে, সেই ঠিক করবে নতুন বসতি কোথায় হবে। আর হ্যাঁ, রাজার মুকুটও তার মাথাতেই উঠবে।
পর দিন সকালে রম্যু দেখে ছয়টি পাখি আর রম্যুলাস দেখে বারোটি পাখি। রম্যুলাস দাবি করে সে প্রথমে ছয়টি ও পরে ঐ বারোটি পাখি দেখেছে, সুতরাং জয় তারই। এপ্রিল ২১, ৭৫৩ (খ্রি.পূ.) রম্যুলাস নতুন বসতির নির্মাণ শুরু করে। রম্যু বাধা দিলে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর রম্যুলাস নতুন তার রাজ্যের নাম দেয় ‘রোম’। নিজেকে ঘোষণা করে রোমের প্রথম রাজা হিসেবে। রোমানদের মধ্যে এই ব্যাবলোনিয় ক্যালেন্ডার চালু করেছিল রাজা রম্যুলাস, খ্রিষ্ট জন্মের ৮০০ বছর পূর্বে। রোমানদের প্রাচীন পাঁজি বা ক্যালেন্ডার ছিল ১০ মাসের বা ৩০৪ দিনের। তিন শ বছর পর রাজা নুমা পম্পিলিউস ‘জনুঅরিউস’ এবং ‘ফেব্রুঅরিউস’ নামে নতুন দুটি মাস প্রাচীন ক্যালেন্ডারের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে, যা প্রাচীন রোমান সৌর ক্যালেন্ডার হিসাবে পরিচিতি পায়। তারপর আবার চলে যায় কয়েক শ বছর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল সৌর ক্যালেন্ডারটি নিখুঁঁত নয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই সমস্যা দূর করতে রোমের সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদদের নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। এরপর সিজার যে ক্যালেন্ডারটি প্রচলন করেন সেটিকে আমরা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসাবে জানি। এই জুলিয়ান ক্যালেন্ডারটি বর্তমান আধুনিক সৌর ক্যালেন্ডারের খুবই কাছাকাছি। সিজারের নতুন ক্যালেন্ডার অনুসারে পয়লা জানুয়ারিতে শুরু হয় নতুন বছর। আর এই নতুন বছর শুরু হতো ‘জানুস’ দেবতার নামে আরাধনার মাধ্যমে। ‘জানুস’ দেবতার মাথা ছিল দুটি, সামনে ও পেছনে—যা দিয়ে সে অতীত ও ভবিষ্যৎ দুই-ই দেখতে পেত।
রোমানরা নববর্ষ উৎসব পালন করত দেবতা ‘জানুস’-এর নামে বলিদান দিয়ে, নিজেদের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান করে, লরেল পাতা দিয়ে ঘরবাড়ি সজ্জিত করে আর নানারকম খানাপিনা আয়োজনের মাধ্যমে। তারপর আবার পার হয়ে যায় হাজার বছর। মেডিভ্যাল ইউরোপে খ্রিষ্টান পাদ্রিরা প্যাগানদের পয়লা জানুয়ারি নতুন বছরের উত্সব পালন বাতিল করে, যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব পালন করা শুরু করে ২৫ ডিসেম্বর, নতুন বছরের উৎসব শুরু করে ২৫ মার্চ।
আবার পার হয়ে যায় কয়েক শ বছর, পোপ গ্রেগার (ত্রয়োদশ) পয়লা জানুয়ারি নতুন বছরের উৎসব পুনরায় প্রবর্তন করেন ১৫৮২ সালে। এই ক্যালেন্ডারটিই আধুনিক বিশ্বে ‘গ্রেগরি ক্যালেন্ডার’ হিসাবে সমাদৃত।