দীর্ঘ ২২ বছর প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হিসাবে ছবি তোলার মাধ্যমে জাহিদুর রহমান বিপ্লব বাংলাদেশের মৌলিক সৌন্দর্য্য-সুষমা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং জীবনযাপনসহ সর্বোপরি বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। এরপর মনস্থির করেছেন চলচ্ছিত্রে। গত বছর মুক্তি পেয়েছে তার পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘ওমর ফারুকের মা’। সরকারি অনুদানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাটি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলো।
সম্প্রতি ফটোগ্রাফার থেকে চলচ্চিত্রে থিতু হওয়াসহ নানা বিষয়ে ইত্তেফাক অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
ইত্তেফাক: আলোকচিত্র থেকে চলচ্চিত্রে কেন এলেন? কীভাবে এলেন?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: আমার মনে হয়, একটি ছবি বা সিরিজ অফ ফটোগ্রাফি দিয়ে ভাবপ্রকাশ/নিজের মতাদর্শ প্রকাশের ব্যাপারটা সীমিত! সেখান থেকেই ভিজ্যুয়ালের প্রতি একটা ঝোঁক গত ১২/১৩ বছর ধরে। ফিল্ম নিয়ে গ্রাজুয়েশন করতে ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে (আমেরিকা) ভর্তি হই। যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত আমেরিকান এম্বেসি আমার ভিসা প্রত্যাখ্যান করে! পরে হাবিব আঙ্কেল (হাবিবুর রহমান খান) আমার চলচ্চিত্রে আসার জন্য আশীর্বাদ হয়ে হাজির হন। পড়তে যাওয়ার বিষয়টি জেনে আমাকে উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, গৌতম ঘোষের (ফিল্মমেকার/ চিত্র পরিচালক, ইন্ডিয়া) সঙ্গে কাজ করতে। ‘শঙ্খচিল’ গৌতম ঘোষের এই প্রোডাকশনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। তার সঙ্গে কাজ করি এই মুভিতে। উনার সঙ্গে এই প্রোডাকশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আর শেখার জায়গাটি আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছে ফিল্মমেকিংয়ে।
ইত্তেফাক: সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে কার সঙ্গে প্রথম আলোচনা হয়? এবং কারা আপনাকে বেশি সহযোগিতা করেছেন?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: আমার কাছের ও শুভাকাঙ্খী কিছু মানুষকে গল্পটি শেয়ার করি, ভিজ্যুয়াল বর্ণনা করি। একদিন সামসুদ্দিন হীরা ভাইকে পুরা বিষয়টা নিয়ে যখন গল্প করছিলাম তখন তিনি আমাকে স্ক্রিপ্টটি মাসুম রেজা ভাইকে দিয়ে কারেকশন করিয়ে নিতে পরামর্শ দেন! মাসুম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্যতা হীরা ভাই জানতেন। আমিও দেরি না করে মাসুম ভাইকে ফোন করি। দেখা করি তার সঙ্গে। উনি অনেক আগ্রহ নিয়ে আমার গল্পটি শোনেন। আমি ভিজ্যুয়ালটিও মাসুম ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করি। শেয়ার করি আমার ভাব-চিন্তা। একপর্যায়ে মাসুম ভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে বলে, বিপ্লব ‘গল্পটা একটা বারুদ’ এইটা বিস্ফোরণ করবে, ক্লিক করবে! শুরু থেকেই মাসুম ভাই উৎসাহ দিয়েছেন। ‘ওমর ফারুকের মা’ স্ক্রিপ্টটি শেষমেশ চূড়ান্ত হয়। অনুদানের জন্য জমা দিতে উৎসাহিত করেন মাসুম ভাই-ই! অনুদানের জন্য স্ক্রিপ্ট জমা দেওয়ার যে আনুষ্ঠানিকতা বা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস তা আমার রেডি ছিলো না। সত্যি কথা বলতে ‘ওমর ফারুকের মা’র এ পর্যন্ত অনেকেই আমাকে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন। আমি যথেষ্ট আশাবাদী ‘ওমর ফারুকের মা’ দর্শক নন্দিত ছবি হবে ইনশাল্লাহ!
ইত্তেফাক: ‘ওমর ফারুকের মা’ ছবিটি করার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: জাতি হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, দীর্ঘ সংগ্রাম আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মুক্তির লাল-সবুজ পতাকা। আর বিশ্বমানচিত্রে গৌরবজনক এক স্থায়ী ঠিকানা। অধিকৃত পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রাম, ও লাখো প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতা আমাদের গৌরবজনক অধ্যায়। পাশাপাশি বেদনারও। যুদ্ধ মানেই দগদগে ক্ষত। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা। কত মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়। কত আনন্দ-বেদনার রক্তকুসুমে গাঁথা বিজয়ের নির্মাল্যখানি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিলো না। ছিলো আদর্শের লড়াইও। মুক্তিযুদ্ধকেই অনুভব করতেই ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করি। বিষয় নির্বাচিত করেছি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্মৃতিচারণাকে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও অজানা অনেক গল্প বাংলা চলচ্চিত্রে এসেছে গৌরবময় ব্যঞ্জনায়। কিন্তু কোনো ক্যানভাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব হয়নি। তারপরও চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে নানাবিধ কারণে পিছিয়ে আছি আমরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে বিশাল এক ক্যানভাস দরকার। রয়েছে বাজেটের সমস্যাও। আবার বাণিজ্যিকভাবেও এসব ছবি থেকে খুব একটা অর্থ পাওয়া যায় না। তারপরও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে প্রাণিত হয়েছি জন্মের দায়শোধে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই।
ইত্তেফাক: ছবিটির প্রেক্ষাপট শুনতে চাই?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছিন্ন সত্য একটি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে ‘ওমর ফারুকের মা’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। গল্পটি পিরোজপুর জেলার। নেছারাবাদের স্বরূপকাঠি উপজেলার একজন মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক আর তার মায়ের। ২১ বছরের যুবক ওমর ফারুক ছিলেন পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। ওমর ফারুক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে ওমর ফারুক যোগ দেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গ্রুপে। ১৯৭১ সালে ২৩ মার্চ পিরোজপুরের টাউন ক্লাব চত্বরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ওমর ফারুক। পুড়িয়ে ফেলেন শহরের যত পাকিস্তানী পতাকা। আত্মগোপনে থেকে সুসংগঠিত করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধের সময় এক রাতে মাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন ‘রাত্রে ফিরে মায়ের হাতে ভাত খাবেন’। ওমর ফারুকের আর ফেরা হয়নি। ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ওমর ফারুকের মায়ের অপেক্ষা শেষ হয় না! আজও ছেলের অপেক্ষায় তিন বেলা হাঁড়িতে ভাত বসান মা! রাতে সদর দরজা খোলা রাখেন!! ছেলে আসবে সেই বিশ্বাসে!
ইত্তেফাক: ছবিটি নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রে মায়ের ভূমিকায় নন্দিত অভিনেত্রী দিলারা জামানের ভাষা দিয়েই শুরু করি, ‘আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ এটি, এ রকম একটি কাজ না করতে পারলে আমার আফসোস থেকে যেত।’ এই অনুভবের রেশ নিয়ে বলতে চাই, এ কথা সত্য যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্বিক বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্বিক বাস্তবায়নের জন্য বেসামরিক লড়াইটা অব্যাহত রাখাটা মুক্তিযুদ্ধকে আরও সফলতার দিকে নিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের সুফলটা তখন বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছাবে। সমালোচকদের মতই আমিও প্রবলভাবে দাবি জানাই, ‘ওমর ফারুকের মা’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো আমাদের শিক্ষাক্রমে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি বিবেচনা করি দেশপ্রেমের চেতনাবোধ জাগ্রত রাখতে। কারণ সঠিক ইতিহাস-চেতনা না থাকলে মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণির কোনো মৌলিক তফাত থাকে না বলেই দার্শনিক নিটশেদের মতন প্রজ্ঞাবানদের অভিমত। আত্মপচিরয় তুলে ধরতে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে যাওয়াটাই এখন মূল উদ্দেশ্য। কারণ তারাই তো আগামী বাংলাদেশ। যারা নিজেকে জানে না, তারা কী করে গড়ে তুলবে নিজের জন্য সোনার বাংলা?
ইত্তেফাক: পরিচালক হিসেবে প্রথম সিনেমা করতে গিয়ে কোনো বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন কি?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: ভালো-মন্দ দুই অভিজ্ঞতাই আছে। বিশেষ করে শিডিউল নিয়ে কিছুটা ঝামেলা হয়েছে। দেখা যেতো আমার লোকেশন কল টাইম ছিলো সকাল ৭টা। কিন্তু আর্টিস্টরা লোকেশনে আসতো ১১টায়। এছাড়া আমার সিনেমা অনুদান পাওয়ার দেড় মাস পর একই গল্প নিয়ে প্রাণ আরএফএলের সঙ্গে চুক্তি করে একই কাজ করেছে নাজনীন চুমকী। আমার গল্প কপি করে তিনি সেটা করেছেন। সেখানে আমার সিনেমায় দিলারা জামানের স্থানে তিনিই অভিনয় করেছেন। এই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো আমার সামনের পথ সুগম করবে।
ইত্তেফাক: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
জাহিদুর রহমান বিপ্লব: আসলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে চাই না। কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বলতে চাই। আমার নিজের কিছু স্বপ্ন দীর্ঘায়িত/বাস্তবায়নের জন্য ফিল্মমেকিংয়ের মধ্যে দিয়ে দেশটাকে তুলে ধরা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ও সম্পদের বিপুল সমাহার বাংলাদেশ আসলেই অনেক সুন্দর একটি দেশ। আমাদের আছে সমৃদ্ধ কৃষ্টি কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, লাইফস্টাইল ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনার একটি নুতন মাইলফলক। আমার কাজের মধ্যে দিয়ে পজিটিভলি বিষয়ভিত্তিক দেশকে তুলে ধরা আর সেটার একটি ‘বিশেষ প্লাটফর্ম সিনেমা’। এছাড়া একান্ত স্বপ্ন বাংলাদেশে সঠিকভাবে একটি ফটোগ্রাফি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। ফটোগ্রাফি নিয়ে আমার চলমান বই লেখার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা। আর ভালো কিছু সিনেমা দেশকে উপহার দেওয়া।