‘ওড়িশি’ ভারতীয় নৃত্য কলার এক অসামান্য ধারা। শ্রীক্ষেত্র পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও কোনারকের সূর্য মন্দিরে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপনার ঐতিহ্য এই নৃত্যশৈলীকে অসামান্য স্বকীয়তা দিয়েছে। ‘ওড়িশি’ নৃত্যশিল্পী শ্রী জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী সম্প্রতি বাংলাদেশের এসেছেন। আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পগুণ সম্পন্ন এই নৃত্য ধারাসহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেন ইত্তেফাক অনলাইনের সঙ্গে।
কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এলেন, কেমন লাগছে?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের ১২৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে দুইদিন ব্যাপি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এখানকার অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী মহারাজের আমন্ত্রণে আমি এখানে এসেছি। দুইদিনেই আমি এখানে ‘ওড়িশি’ নৃত্য পরিবেশন করেছি।
‘ওড়িশি’ নৃত্য সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: ভারতবর্ষে একটি অঞ্চলের নাম ওড়িসি। এটি ভারতীয়দের কাছে ক্লাসিক্যাল নাচ হিসেবেই পরিচিত। এই নাচটির মাধ্যমে আমরা জগন্নাথ মন্দির ও কোনারকের বিভিন্ন মন্দিরে ক্যাপচার করি। এই নাচে আমরা যে ফিগারগুলো দেখাই সবগুলোই ঈশ্বর ভগবানের। যেমন ধরুন- রাম, সীতা, হুনুমানজি, বুদ্ধ, দেবি, দূর্গা, শিবসহ বিভিন্ন পশ্চারে এই নাচগুলো দেখানো হয়। এই নাচটি পুরোপুরি জগন্নাথ দেবের উৎসর্গিত নাচ।
এই নাচ শেখার আগ্রহ জন্ম নিলো কীভাবে?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: ওড়িশি নৃত্যের এই রূপবৈচিত্র্যময় ভুবনে আমার প্রবেশ শৈশবেই। মা শ্রীমতী কল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই সাধনার সূচনা হয়। ওড়িশির কিংবদন্তী রূপকার পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের প্রত্যক্ষ শিষ্য গুরু গিরীধারী নায়কের কাছে প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়া শ্রীমতী রাজশ্রী বিশ্বাসের কাছে নিয়মিত ওড়িশি নৃত্যের পাঠ গ্রহণ করি। শ্রীমতী স্বাতী সরকারের কাছেও কত্থক নৃত্যশৈলীর শিক্ষা গ্রহণ করি। পরে অবশ্য মা চাননি আমি এই নৃত্য চালিয়ে যাই। কিন্তু ততদিনে এই নাচ আমার মনের ভেতরে ঢুকে যায়। সেই থেকে এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।
যতোদূর জানি, আপনি ভারতবর্ষ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে পারফর্ম করেছেন। তো কোন কোন দেশে পারর্ফম করেছেন?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: ২০০৭-এ চীনের ডালিতে আন্তর্জাতিক ডান্স উৎসব উপলক্ষে অংশগ্রহণ করি। এছাড়া সিঙ্গাপুর এবং ব্যাঙ্ককে এই নাচ পরিবেশন করেছি। ২০১৮-তে জার্মানির বার্লিন, ফ্রান্সে ইণ্ডিয়া হাউস–প্যারিস এবং রামকৃষ্ণ সেন্টার গ্রেডটজ, ইতালির রোম ও নরওয়ের অসলোতে নাচ পরিবেশনের সুযোগ পেয়েছিলাম। ২০১৯ এর অক্টোবর মাসব্যাপী দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান, চাট্সওয়ার্থ, লেডিস্মিথ, নিউক্যাসেল, পিটারমারিসবার্গ, ফিনিক্স ও জোহানেসবার্গে নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম।
‘ওড়িশি’ নৃত্যটি মানুষ কীভাবে গ্রহণ করছে?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: এযুগে নৃত্য মানেই আনন্দ-উল্লাস। কিন্তু এটা তো তা নয়। এটা সম্পূর্ণ আলাদা। ‘ওড়িশি’ একটি আধ্যাত্মিক নৃত্য। ধীরে ধীরে মানুষ এই নাচটি গ্রহণ করছে।
এই নাচ যারা শিখতে চান তাদের করণীয় কি?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: এই নাচটি কিন্তু সহজ নাচ নয়। এটা শিখতে কঠোর পরিশ্রম-সাধনা লাগে। দেখুন, আমি প্রায় ৩০ বছর ধরেই আমি এই নাচটি করছি। তবে ইচ্ছে শক্তি থাকলে সবই সম্ভব।
‘ওড়িশি’ নৃত্য শিখতে গিয়ে আপনার কী কী প্রতিবন্ধকতা এসেছিলো?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: প্রথমত, মানুষ বলতো ছেলে নাচ করবে কেনো? এই নাচ তো মেয়েরা করে। ছেলেরা সাধারণত এই নাচ করে না। অনেকেই বলতো ছেলেরা এই নাচ করলে তাদের মাঝে মেয়েলি ভাব চলে আসে। এটা নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতো। তখন মা এই নাচ করতে বারণ করলেন। কিন্তু মা আমাকে খানিকটা বছর শিখিয়ে আটকে দিলেন। তখন আগ্রহটা আরো বেড়ে গেলো।
বাংলাদেশের কেউ যদি এই ‘ওড়িশি’ নৃত্য শিখতে চান তাদের জন্য কোনো পরামর্শ?
জগৎজ্যোতি ব্যানার্জী: বাংলাদেশের মানুষের শেখার খিদে অনেক বেশি। এটা আমি জানি। কেউ যদি এই নাচ শিখতে চান তাদের জন্য বলবো। বাংলাদেশেও আমাদের কিছু সতীর্থ আছে। তাদের কাছেও এই নৃত্য শিখতে পারেন। এছাড়া আমরা আছি। চাইলে আমরা বারবার আসতে পারি। এই নাচ বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের অনেকেই শিখছে।