ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের চাহিদা বেড়েছে। এর ফলে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে স্বল্প সময়ের জন্য ধার করা অর্থের সুদের হার বা কলমানি রেটও বেড়েছে। ২০১৬ সালের মে মাসের পর এখন সর্বোচ্চ লক্ষ্য করা যাচ্ছে কলমানি রেট। গত সপ্তাহে ওভারনাইট কলমানি রেট ৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগদ টাকার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ধার করার পরিমাণ বাড়ছে। তাছাড়া ডলার কিনতে এখন অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে। সেজন্য কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে নগদ টাকার টান পড়েছে। এর প্রভাব পরেছে কলমানি বাজারে।
কলমানি কী : ‘কলমানি’ বলতে বোঝায় আন্তঃব্যাংক ঋণ প্রদান এবং গ্রহণকে। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের জন্য এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে চাহিবামাত্র পরিশোধ করার শর্তসাপেক্ষে যে ঋণ গ্রহণ করে তাই কলমানি। এটা এক দিনের জন্যও হতে পারে। এর বেশি দিনের জন্যও হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে গত সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে রবিবার গড়ে ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ সুদে মোট ৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এর পরের দিন সোমবার কলমানি রেট ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ওই দিন লেনদেন হয় ছয় হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। মঙ্গলবার গড়ে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ সুদে লেনদেন হয় ৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। বুধবার এক দিনের জন্য কলমানি মার্কেট থেকে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা ধার করেছে। এ ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার ছিল ৬ শতাংশ। গড় সুদহার ছিল ৭ শতাংশ। এদিন ব্যাংকগুলো চার দিনের শর্ট নোটিশে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ৩১০ কোটি টাকা ধার করে। পাঁচ দিনের জন্য ৫৫ কোটি টাকা, ৬ দিনের জন্য ৭৫ কোটি টাকা, সাত দিনের জন্য ৩১৯ কোটি টাকা, ১১ দিনের জন্য ১০০ কোটি টাকা, ১২ দিনের জন্য ৫০ কোটি টাকা, ১৩ দিনের জন্য ৪৮ কোটি টাকা ও ১৪ দিনের জন্য ৭৮০ কোটি টাকা ধার করে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকগুলো সাধারণত তিনটি মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে অর্থ ধার করে। এক দিনের জন্য কল মানি ঋণ, দুই থেকে ১৪ দিনের জন্য স্বল্প নোটিশ ঋণ, ৯০ থেকে ১৮০ দিনের জন্য মেয়াদি ঋণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার পর ব্যাংকগুলোয় উদ্বৃত্ত তারল্য কমে গেছে। সংকটের কারণে গত এক বছরে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৬৫ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর গত ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৬৫ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। তারল্য কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিতভাবে ধার করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ জানুয়ারি কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর আগে, গত ১৮ জানুয়ারি নিয়েছে ৭ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সুদ গুনতে হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। সম্প্রতি দেশে মূল্যস্ফীতি কমাতে রেপো রেট বা নীতি সুদহার দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তফসিলি ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলে আগে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ দিতে হতো, এখন দিতে হবে ৬ শতাংশ। রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সালের মে মাসে কলমানি গড় সুদহার ছিল ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ঐ বছর শেষে কলমানি মার্কেটের গড় সুদহার ৩ দশমিক ৭৩। ২০১৭ সালের শেষে ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৬১ শতাংশে। ২০১৯ সালের শেষে এ হার ছিল ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এরপর ২০২০ সালের বেশির ভাগ সময় কলমানি রেট ২ শতাংশের নিচেই ছিল।