মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

মশা নিধনে ভুল পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন, দায় কার?

আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:০৯

সরকারি হিসেবে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত বছরে ঢাকায় প্রাণ হারায় ১৭৩ জন মানুষ। আক্রান্ত হয় প্রায় ৪০ হাজার। যা সারা দেশে মোট মৃত্যুর ৬১ শতাংশ। যারা শুধু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এটি ছিল সরকারি খাতায় তাদের হিসেব। এর বাইরেও হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এখনো প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অথচ এতদিন মশা দমনে সিটি করপোরেশন তাদের কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও উত্তর সিটির মেয়র যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জানতে পারলেন মশা দমনে তাদের পদ্ধতি ভুল ছিল। সঙ্গে অর্থেরও অপচয় হয়েছে। এতগুলো প্রাণ যাওয়ার পর যখন পদ্ধতি ভুল সম্পর্কে জানা গেল, তখন এই দায় কার—এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, তারা একাধিকবার রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনকে মশা দমন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে বলেছেন। কিন্তু তারা তা শোনেনি। 

এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমরা আগেই থেকেই বলে আসছি এ দেশে সমন্বিত বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা প্রয়োগ না করলে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। উত্তরের মেয়র এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বুঝতে পারার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বলে আসছি। সেগুলো  হলো—পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ, বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, ক্যামিক্যাল বা কীটনাশক কন্ট্রোল এবং কমিউনিটি পার্টিসিপেশন। কিন্তু বাংলাদেশে কীটনাশক প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ফগিং অন্যতম। কিন্তু বেশির ভাগ ফগিং ভালো ফলাফল দেয় না। এক্ষেত্রে আমরা লার্ভিসাইডিংকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছি। এর পাশাপাশি বাকি তিনটি বিষয়কেও সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে মশা দমনে ভূমিকা নিলে মশা দমন হবে। এছাড়া কীটনাশক প্রয়োগে কার্যকারিতা নিয়েও পরীক্ষার দরকার রয়েছে। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা নেই। যেটি যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে রয়েছে। এর মাধ্যমে কিন্তু ভালো সুফল পাওয়া যায়।

বর্তমানে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিদর্শনে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একটি প্রতিনিধিদল। দলের নেতৃত্বে রয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তাকে উদ্ধৃত করে গত শনিবার ডিএনসিসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি; বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। মিয়ামিতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা ঢাকায় মশা নির্মূলে কাজে লাগাতে চাই। দ্রুত সময়ের মধ্যে মশার প্রজাতি চিহ্নিত করতে একটি ল্যাব স্থাপন করবে ডিএনসিসি।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ‘ল’ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণ ও অর্থায়নে ফ্লোরিডা সফরে রয়েছে প্রতিনিধিদলটি।

আর্থিক অপচয়ের বিষয়টি সামনে এলে ঢাকার দুই সিটির মশা দমনের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতি বছরেই মশা দমনে বাজেট বেড়েছে। অথচ মশা দমনে তেমন সুফল পায়নি নগরবাসী। প্রতি বছরই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ও মৃত্যুবরণ করেছে। মশা নিয়ন্ত্রণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই সিটি করপোরেশন বরাদ্দ রেখেছে ১৪৭ কোটি টাকা। যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রেখেছে ৪৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, এ বছর মশা নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ ৭ কোটি টাকা বাজেট ছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় মশা নিধনে, এর বাইরে মশা নিধন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে রাখা হয় ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। 

অন্যদিকে উত্তর সিটিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা,  ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২১ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে মশা নিধনে বরাদ্দ ছিল ৭০ কোটি টাকা।

ভুল পদ্ধতির বিষয়ে উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, আসলে মেয়র মহোদয় কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চান, সে বিষয়ে মেয়র মহোদয় ফিরলে বিস্তারিত জানা যাবে। এ মুহূর্তে আমার তেমন কিছু বলা ঠিক হবে না।

এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, আসলে মেয়র মহোদয় যা বলেছেন এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তবে পৃথিবী যেহেতু পরিবর্তনশীল, সেহেতু কোনো টেকনোলজি এলে আমাদের মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করব। আমরা এখন আগের পদ্ধতিতেই মশক দমন চালিয়ে যাচ্ছি।

ইত্তেফাক/এমএএম