খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকের জটলা পেরিয়ে দোতলায় উঠতেই দেখা যায়, শয্যা পেতে শুয়ে আছেন অসংখ্য রোগী। তাদেরই একজন ষাটোর্ধ্ব সেলিম হাওলাদার। হার্টের রোগী। খুলনা মহানগরীর ফুলবাড়ীগেট এলাকায় তার বাড়ি। অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে। শয্যা না পেয়ে ছয় দিন ধরে হাসপাতালের বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘বাবারে, সেই ২১ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হইছি। সিট পাইনি, তাই হাসপাতালের বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছি।’ শুধু সেলিম হাওলাদারই নন, শয্যা সংকুলান না হওয়ায় তার মতো শত শত রোগীর ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে।
হাসপাতালের বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ সবখানেই রোগীর প্রচণ্ড চাপ। মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, গাইনি সব বিভাগেই ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি রোগী। আর এই রোগীর চাপ সামলাতে অসহায় অবস্থা খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীদের চাপের কথা ভেবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালটিকে অতিদ্রুত ২ হাজার শয্যায় উন্নীত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞসহ দরকার ৮০০ চিকিৎসক।
সরেজমিন দেখা গেছে, চিকিৎসা পাওয়ার আশায় হাসপাতালের বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টার, বারান্দা, চিকিৎসকের চেম্বার, লিফটের সামনে থেকে শুরু করে বাথরুমের দরজা পর্যন্ত সর্বত্রই রোগী। শাশুড়ি জিন্নাতুন্নেছাকে (৮০) নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার আইচপাড়া গ্রামের তাহমিনা বেগম। শয্যা না পেয়ে গত পাঁচ দিন ধরে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তার শাশুড়িকে। তাদের পাশে কয়রা থেকে আসা আরেক জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন একইভাবে।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে এসে বিপুলসংখ্যক রোগী শয্যা না পেয়ে ঠাঁই নেন হাসপাতালের বারান্দায়। এভাবে ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়া খুব কঠিন। উপায় নেই, রোগীর চিকিৎসা তো করাতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের শয্যা রয়েছে মাত্র ৫০০টি। গত বুধবার ঐ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ১ হাজার ৩২৯ জন। যা ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ। এছাড়া শিশু ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা ৫৫টি। সেখানে রোগী ভর্তি ছিল ২০৪ জন। যা হাসপাতালের শয্যার তুলনায় প্রায় চার গুণ। হাসপাতালের এই বিপুল পরিমাণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে মাত্র ২০৭ জন চিকিৎসককে। তার ওপর অনেক চিকিৎসকই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক। একদিকে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান; অপরদিকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান—সব মিলিয়ে চিকিৎসকদের নাজেহাল অবস্থা।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী জানান, দীর্ঘদিন ধরে ৮১টি চিকিত্সকের পদ খালি। তবে হাসপাতালে সবচেয়ে সংকট চলছে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসকের (অবেদনবিদ)। হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩৮টি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ৩০টি পদই শূন্য রয়েছে। এ কারণে রোগীদের অপারেশন করতে খুব জটিলতায় পড়তে হচ্ছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রবিউল হাসান বলেন, মাত্র ২০৭ জন চিকিৎসক দিয়ে শয্যাসংখ্যার প্রায় তিন গুণ বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া খুব কঠিন কাজ। হাসপাতালটিকে দেড় হাজার শয্যায় উন্নীত করার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। তবে এখন দেখছি, এই হাসপাতালকে ২ হাজার শয্যায় উন্নীত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসক দরকার ৮০০ জন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনার সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, খুব কম জনবল দিয়ে শয্যার প্রায় তিন গুণ বেশি রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন।