শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে যাওয়া এড়াতে জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন যে রুশ

আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:৫১

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রুশ সেনাবাহিনীতে আরও সেনা সমাবেশের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু এ্যাডাম কালিনিনের (ছদ্মনাম) কোনো ইচ্ছেই ছিল না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দেবার। তিনি ভাবতে শুরু করলেন, কীভাবে এই 'মোবিলাইজেশন' এড়ানো যায়।  

তার মনে হলো, সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ ঠেকানোর সেরা উপায় হতে পারে একটাই, জঙ্গলে গিয়ে থাকা। কালিনিন ছিলেন একজন আইটি স্পেশালিষ্ট বা তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। শুরু থেকেই তিনি ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। 

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রুশ সেনাবাহিনীতে আরও সেনা সমাবেশের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন।

তিনি যে এপার্টমেন্ট ভবনে থাকতেন তার দেয়ালে তিনি সেঁটে দিয়েছিলেন 'যুদ্ধকে না বলুন' লেখা এক পোস্টার। আর এজন্য তাকে দুই সপ্তাহের জন্য জেল খাটতে হয়েছিল, দিতে হয়েছিল জরিমানাও।

সুতরাং রাশিয়া যখন ইউক্রেন যুদ্ধে আবার জয়ের ধারায় ফিরে আসার চেষ্টায় ৩ লাখ সেনা নিয়োগের উদ্যোগ নিলো তখন কালিনিন আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না ইউক্রেনীয়দের হত্যার জন্য যুদ্ধে যোগ দেবার ঝুঁকি নিতে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এড়াতে সে সময় লাখ লাখ রুশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। 

তিনি যে এপার্টমেন্ট ভবনে থাকতেন তার দেয়ালে তিনি সেঁটে দিয়েছিলেন 'যুদ্ধকে না বলুন' লেখা এক পোস্টার।

কিন্তু এ্যাডাম কালিনিন এমন কিছু করতে চাননি। তিনটি জিনিস তাকে রাশিয়ার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল, বন্ধুবান্ধব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও পরিচিত জগত ছেড়ে যাবার অনীহা। কালিনিনের বয়স তিরিশের কোঠায়। 

বিবিসিকে তিন জানিয়েছিলেন, তার নিজস্ব যে ছোট জগতের ভেতর থাকতে তিনি আরাম বোধ করেন তা ছেড়ে যাওয়াটা ছিল তার জন্য খুবই কঠিন একটা পদক্ষেপ। তিনি বলেন, 'আমি যে এ জীবনেও খুব আরামে আছি তা নয়। কিন্তু তার পরও এটা ছেড়ে যাওয়াটা মানসিকভাবে খুবই কঠিন ছিল।'

কিন্তু এ্যাডাম কালিনিন এমন কিছু করতে চাননি।

তাই তিনি এমন এক পদক্ষেপ নিলেন যা সচরাচর কেউ করে না। তিনি তার স্ত্রীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন এক জঙ্গলে। সেখানে এক তাঁবু থাটিয়ে তিনি থাকছেন প্রায় চার মাস ধরে। সেই জঙ্গলে ইন্টারনেট পাবার জন্য তিনি গাছের সাথে একটা এন্টেনা বেঁধেছেন।  

বিদ্যুতের জন্য বসালেন সোলার প্যানেল। কিছুদিন পর পর তার স্ত্রী জঙ্গলে নিয়ে তার জন্য কিছু খাবার দিয়ে আসতেন। সেই বনে তাকে সহ্য করতে হয়েছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া। এক এক সময় তাপমাত্রা শূন্যের ১১ ডিগ্রি নিচে নেমে যেতো।

সেখানে এক তাঁবু থাটিয়ে তিনি থাকছেন প্রায় চার মাস ধরে।

কিন্তু তার পরও তার মনে হয়েছিল, সেনাবাহিনীকে নিয়োগ ঠেকানোর জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো উপায়। কারণ আপনি যদি সব যোগাযোগের বাইরে থাকেন, কর্তৃপক্ষ যদি আপনার হাতে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ডাক পৌঁছে দিতে না পারে তাহলে আপনাকে কেউ যুদ্ধে যেতে বাধ্য করতে পারবে না।

তিনি বলছিলেন, 'ওরা যদি শারীরিকভাবে আমার হাত ধরে সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তির অফিসে নিয়ে যেতে না পারে তাহলে আপনি ৯৯% নিরাপদ যে আপনাকে মোবিলাইজেশন বা অন্য কোন রকম হয়রানি করা যাবে না।

কিন্তু তার পরও তার মনে হয়েছিল, সেনাবাহিনীকে নিয়োগ ঠেকানোর জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো উপায়।

কোনো কোনো দিক থেকে কালিনিনের জীবন আগের মতই আছে। তিনি এখনো সেই একই চাকরি করেন, প্রতি দিন আট ঘণ্টা। তবে শীতের সময় দিন ছোট হয়ে যায় বলে আট ঘণ্টা কাজ করার মত সৌর বিদ্যুৎ পান না তিনি। ফলে শনিবার ও রোববার কয়েক ঘন্টা কাজ করে সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে দিতে হয়।

তার কিছু কিছু সহকর্মী এখন আছেন কাজাখিস্তানে। সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তি শুরু হতেই তারা রাশিয়া ছেড়ে সেখানে চলে গিয়েছিলেন। তবে একটা দূরপাল্লার এন্টেনা পাইন গাছের গায়ে বেঁধে তিনি যে ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠা করেছেন তা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ও যোগাযোগ তার জন্য তেমন কোনো সমস্যা নয়।

তিনি এখনো সেই একই চাকরি করেন, প্রতি দিন আট ঘণ্টা।

কালিনিন 'আউটডোরের' ভক্ত, বেড়াতে ভালোবাসেন তিনি। রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাম্পিং করে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে অনেকগুলো ছুটির দিন কাটিয়েছেন। জঙ্গলে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেবার সময়ই তিনি এজন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।

এই বনবাসী জীবনে তিনি যে টিকে থাকতে পেরেছেন তার এক বড় কারণ তার স্ত্রীর ভূমিকা। নতুন বছর শুরুর সময় কয়েকদিনের জন্য জঙ্গলের ভেতর কালিনিনের তাঁবুতে এসে থেকেছিলেন তার স্ত্রী। 

জঙ্গলে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেবার সময়ই তিনি এজন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।

তিনি প্রতি তিন সপ্তাহে একবার করে খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী একটা বিশেষ জায়গায় নামিয়ে দিয়ে যান। সেই দিনটায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দুই জনের মুখোমুখি দেখা হয়। এরপর কালিনিন তার খাবারগুলো আরেকটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যান। 

রান্নার জন্য তিনি একটি লাকড়ির চুলো বানিয়ে নিয়েছেন। কালিনিন বলেন, 'আমার কাছে আছে ওটস, ময়দা, চা, কফি, চিনি। ফল বা তাজা শাকসবজি বেশি নেই, কিন্তু তার পরও এটা খারাপ নয়।

রাশিয়াতে বরফের মধ্যে মাছ ধরার সময় জন্য যে সব বড় বড় তাঁবু ব্যবহার করা হয়, সে রকম একটি তাঁবু দিয়েই জঙ্গলে নিজের ঘর বানিয়েছেন কালিনিন।

রাশিয়াতে বরফের মধ্যে মাছ ধরার সময় জন্য যে সব বড় বড় তাঁবু ব্যবহার করা হয়, সে রকম একটি তাঁবু দিয়েই জঙ্গলে নিজের ঘর বানিয়েছেন কালিনিন। প্রথম দিকে জঙ্গলে আসার পর প্রথম দিকে তিনি দুইটি তাঁবু বানিয়েছিলেন। একটি থেকে আরেকটিতে যেতে পাঁচ মিনিট লাগতো। 

একটাতে ছিল ইন্টারনেট সংযোগ, যেখানে বসে তিনি কাজ করতেন। দ্বিতীয় তাঁবুটিতে তিনি ঘুমাতেন, যেটা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা জায়গায়। তবে যখন শীতকাল শুরু হলো এবং আবহাওয়া ঠাণ্ডা হতে শুরু করলো তখন তিনি একটা তাঁবুতেই থাকা ও কাজ করার ব্যবস্থা করলেন।

দ্বিতীয় তাঁবুটিতে তিনি ঘুমাতেন, যেটা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা জায়গায়।

কিছু দিন আগে সেখানকার তাপমাত্রা শূন্যের ১১ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়। কালিনিন আগে অনুমান করতে পারেননি যে এতটা ঠাণ্ডা পড়বে। তবে এখন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে, বরফ গলতে শুরু করেছে। কালিনিনও মনে করছেন, তিনি অন্য আর কোথাও না গিয়ে এখানেই থাকবেন।

কালিনিন এখনো সামরিক বাহিনীতে যোগ দেবার ডাক পান নি। তবে পরিস্থিতি প্রতিদিনই বদলাচ্ছে এবং তার আশংকা ভবিষ্যতে কোনো এক সময় হয়তো তার কাছেও ডাক আসতে পারে। সরকারি নীতি অনুযায়ী, আইটি কর্মীরা সামরিক বাহিনীতে তালিকাভুক্ত হবার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। 

কিছু দিন আগে সেখানকার তাপমাত্রা শূন্যের ১১ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়।

কিন্তু রাশিয়াতে এমন অনেক খবর বেরিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সেনা সমাবেশের কথা ঘোষণা করেছিলেন ২১শে সেপ্টেম্বর।

তার কিছুদিন আগেই ইউক্রেনীয় বাহিনী খারকিভ অঞ্চলে এক দ্রুতগতির পাল্টা অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রুশ বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করে। পুতিন জানিয়েছিলেন, পশ্চিমা শক্তির হাত থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য অতিরিক্ত সেনা সমাবেশ দরকারি হয়ে পড়েছিল।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সেনা সমাবেশের কথা ঘোষণা করেছিলেন ২১শে সেপ্টেম্বর।

কিন্তু রাশিয়ার ভেতরে অনেকেই এর বিরোধী ছিল। সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তি এড়াতে লক্ষ লক্ষ লোক এসময় রাশিয়া ছেড়ে পালাতে থাকে। সীমান্তে তৈরি হয় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। রাশিয়ার সমাজের ওপর এই মোবিলাইজেশনের গভীর প্রভাব পড়েছে।

এর আগে পর্যন্ত অনেক রুশ নাগরিক ভেবেছিলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ চললেও তারা আগের মতই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। এটা ঠিক যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আর্থিক লেনদেন কঠিন হয়ে পড়েছিল এবং দোকানপাট থেকে পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। 

সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তি এড়াতে লক্ষ লক্ষ লোক এসময় রাশিয়া ছেড়ে পালাতে থাকে।

কিন্তু সমাজের ওপর তার প্রতিক্রিয়া ছিল সামান্য। কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার আদেশ এ যুদ্ধকে অনেক রুশ পরিবারের ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। অনেক পরিবারের পিতা, পুত্র বা ভাইকে স্বল্প সময়ের নোটিশে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা হয়। 

অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রশিক্ষণ ছিল সীমিত, যুদ্ধের সরঞ্জাম ছিল অপর্যাপ্ত। রাশিয়ায় অনেকের কাছেই ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল একটা দূরের ব্যাপার, কিন্তু এ ঘটনার পর তাকে উপেক্ষা করার আর কোন উপায় ছিল না। তারপরও রাশিয়ার ভেতরে প্রকাশ্য প্রতিবাদের ঘটনা ছিল বিরল। 

কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার আদেশ এ যুদ্ধকে অনেক রুশ পরিবারের ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে।

ইউক্রেনে ও পশ্চিমা দেশগুলোতে এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু কালিনিন জানিয়েছেন, প্রতিবাদ করতে গেলে কী বিপদ হয় তা নিয়ে লোকের মনে  সঙ্গত কারণেই ভয় ছিল। এটা একটা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং তারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর। 

গত ছয় মাসে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে অনেকগুলো আইন করা হয়েছে। এখন লোকে যদি যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুখ খোলে তাহলে রাষ্ট্র তাদের পেছনে লাগবে। কালিনিনের এই বনবাসী জীবন অনলাইনে তাকে একটা জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। টেলিগ্রাম এ্যাপে তিনি প্রায় প্রতিদিনই নানা রকম আপডেট দিচ্ছেন এবং তার ফলোয়ারের সংখ্যা এখন ১৭,০০০। 

ইউক্রেনে ও পশ্চিমা দেশগুলোতে এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে।

তিনি ভিডিও পোস্ট করেন, তার চারপাশের বনভূমির ছবি দেন, আরও থাকে তার প্রতিদিনের কাজকর্ম, কীভাবে তার ক্যাম্প সাজানো হয়েছে, এই সব। এর মধ্যে একটা বড় স্থান নিয়েছে কাঠ কাটা। কালিনিন দাবি করেন, তিনি তার আগেকার জীবনযাত্রার অভাব খুব একটা বোধ করেন না।

তিনি জানান, তিনি একজন অন্তর্মুখী মানুষ যার একাকী থাকতে অসুবিধা হয়না। তবে স্ত্রীর জন্য তার মন কেমন করে এবং তাকে তিনি আরও বেশি দেখতে চান। তবে, যুদ্ধে বা কারাগারে যাবার চাইতে এখন তিনি যেভাবে আছেন সেটা অনেক ভালো।

কালিনিন বলেন, 'আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অন্য সময় আমি হয়তো যেসব জিনিসের অভাব বোধ করতাম এখন তা অনেক দূরের বিষয় হয়ে গেছে। আগে যেসব জিনিস গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো এখন সেগুলো আর আমাকে টানে না। এমন অনেকে আছে যারা আমাদের চাইতেও কঠিন অবস্থায় আছে।'

ইত্তেফাক/ডিএস