বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘বিদ্যুতের দাম বাড়ায় চুরি আরও বাড়বে’

আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:১৮

বাংলাদেশে ১৯ দিনের মাথায় আবারো গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন দাম কার্যকর হবে আগামীকাল বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) থেকে। পাইকারি বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বাড়ানের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাও বুধবার থেকে কার্যকর হতে পারে।

এর আগে ১৯ জানুয়ারি থেকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়। আর এবার বাড়ানো হলো আরও পাঁচ শতাংশ। পাইকারি বিদ্যুতের প্রথম দাম বাড়ানো হয় ২১ নভেম্বর ১৯.৯২ শতাংশ যা ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। আর এবার বাড়ানো হয়েছে আট শতাংশ। সরকার নির্বাহী আদেশে এই দাম বাড়িয়েছে, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তোয়াক্কা না করেই।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘প্রতি মাসেই এখন থেকে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। আমরা এভাবে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে সেটা তো ট্যাক্সের  মাধ্যমে আদায় করা হতো। আর মানুষের আয় বাড়ছে বলে বিদ্যুতের ব্যবহারও বাড়ছে।’

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে ভর্তুকির চাপ কমাতে পারত। এই খাতে অপচয় এবং দুর্নীতি কমালেই দাম বাড়াতে হবে না। একইভাবে সরকার যদি দেশে মজুত গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করত তাহলে গ্যাসের দামও বাড়ানোর প্রয়োজন হত না। সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী না হয়ে দাম বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে। ফলে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে। আর সাধারণ মানুষ যারা ঘরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তারা আরও সংকটে পড়বেন। বিদ্যুৎ চুরিও বাড়বে।

দামের চাপ কার ওপর কতটা:

নতুন দাম অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর জন্য আগের চেয়ে ইউনিট প্রতি ২০ পয়সা বেড়েছে। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা, ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬২ পয়সা এবং ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে।

গত ১৪ বছরে সরকার ১১ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এর আগে গত বছর রেকর্ড হারে বাড়ে জ্বালানি তেলের দাম। গ্যাসের দাম গত জুনে গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ১৮ জানুয়ারি তা রেকর্ড ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়।

কে কেমন চাপে পড়বে?

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘দাম বাড়ানোর শেষ চাপটি পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। যারা হাউজহোল্ড গ্রাহক তাদের তো সরাসরি এখন বিদ্যুতের জন্য বাড়তি টাকা গুণতে হবে; কিন্তু এর আরও প্রতিক্রিয়া আছে।’

তার কথা, ‘এখন শিল্প উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে, কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। তাই সাধারণ মানুষকে আরও বেশি দামে পণ্য ও সেবা কিনতে হবে। তাদের আয়ে সেটা সম্ভব না হলে ভোগ আরও কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে। সাধারণ মানুষ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আরও চাপের মুখে পড়লেন।’

আর বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হোসেন বলেন, ‘শুধু তৈরি পোশক শিল্প নয়, রপ্তানিমুখী সব শিল্পই এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিশেষ করে মাঝারি ও ছোট শিল্পের সংকট সবচেয়ে বেশি।  বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে, পরিবহণ (ফ্রেইট) খরচ কমছে ঠিক তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’

তার কথা, ‘আমাদের ডলারের সংকট, মূল্যস্ফীতি নাকাল করে দিচ্ছে। আমরা এখন পোশাক খাতে দেশীয় অনেক কাঁচামাল ব্যবহার করি। তাদেরও উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং কাঁচামালের দাম বাড়বে। এই চাপ আমরা সামলাবো কীভাবে? তাই আমরা এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর না আবেদন করছি।’

বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কতটুকু যৌক্তিক?

এস এস নাজের হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুতের অপচয়, দুর্নীতি ও চুরি বন্ধ করলে দাম বাড়ানোর দরকার হত না। আইএমএফ বিদ্যুতে ভর্তুকি তুলে দিতে বলছে। তারা কিন্তু দাম বাড়াতে বলেনি। কিন্তু সরকারের মাথায় দাম বাড়ানো ছাড়া চুরি দুর্নীতি কমানোর কোনো চিন্তা নাই।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘সরকারের কাছে বিকল্প থাকার পরও এর আগে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমাতে চেয়েছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমাতে চাইছে। আসলে এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। ভালো ব্যবস্থাপনা, অপচয় ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দরকার হত না। এমনিতেই ভর্তুকি কমে আসত।’

তার কথা, ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। আমাদের দেশে যে মজুত গ্যাস আছে তা তোলার ব্যবস্থা করা এবং নতুন নতুন গ্যাস কূপ খনন করার দরকার ছিল। তাহলে আমরা কম দামে গ্যাস পেতাম। উচ্চ মূল্যে এলনজি আমদানি করতে হতোনা। দেশীয় কম দামের গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে খরচ কম পড়ত। অন্য দিকে বিদ্যুৎ খাতে উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যদি বন্ধ করা যায়।  প্রয়োজনের বাইরে কুইক রেন্টালগুলো যদি ধাপে ধাপে বন্ধ করা যায় তাহলে খরচ অনেক কমে আসবে। সরকার যদি তেলভিত্তিক সেচের পরিবর্তে সৌর বিদ্যুৎ ভিত্তিক সেচ চালু করে তাহলেও ব্যয় সাশ্রয় হবে। সরকার এগুলো না করে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে কাজ করছে।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, ‘সরকার তো বিদ্যুতে ভর্তুকি রাখবে না। জ্বালানি তেলে তুলে দিয়েছে। গ্যাসে এখন আর ভর্তুকি নাই, উল্টো ব্যবসা করছে। কিন্তু বিদ্যুৎ অন্ন, বস্ত্রের মতই মানুষের এখন একটি মৌলিক চাহিদা। এখনো সহনীয় পর্যায়ে ভর্তুকি রাখতে হবে। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো সরকারকে দেখতে হবে।’

তার মতে, ‘দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি তুলে দিলেও তো লাভ নেই। কারণ এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, উৎপাদন খরচ বাড়বে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমবে। সরকার যদি আগে থেকেই নিজস্ব গ্যাস তোলার পরিকল্পনা করত, নিজস্ব কয়লার ব্যবস্থা করত তাহলে তো আর সংকট হত না। এখন এটা তো দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনার ব্যাপার। তবে এখনো ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব। যেমন, ডিজেল প্ল্যান্টগুলো বছরে মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ ব্যবহার হয়। এখনো অনেক সিস্টেম লস ও চুরি হচ্ছে। আমার আশঙ্কা বিদ্যুতের দাম বাড়ায় চুরি আরও বাড়বে।’

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

ইত্তেফাক/এএএম