রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক ও সমাজের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, দেশে বহুমুখী সমস্যা ও সংকট রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাবাহিকতা অপরিহার্য। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক চলমান, সেটির সমাধান খুঁজে বের করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। দেশের মানুষ চায় একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক ও ভূ-রাজনীতির বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখতে হবে। আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে দেশের ও জনগণের স্বার্থকে।
সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে দৈনিক ইত্তেফাক আয়োজিত ‘ডেমোক্রেসি: রোড টু ইলেকশন-২০২৪; বাংলাদেশে রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের অতীত ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ‘পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)’-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রকাশক তারিন হোসেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা ও বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল-অতীতে নির্বাচনগুলোর চেয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন কীভাবে ভিন্নতর হবে, বাংলাদেশে ভূ-রাজনীতির প্রভাব, মানবাধিকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ ইত্যাদি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)’-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সমাজে যেই বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, সেটি থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে একটি ভালো নির্বাচন আশা করা যায় না। আর বিভাজন দূর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. মনসুর বলেন, আমি বিশ্বাস করি-চলমান পারস্পরিক অবিশ্বাসের সংস্কৃতিতে দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত রাজনীতিকরাই। একে একে তারা সবকিছু হারাচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের উচিত নিয়ন্ত্রণটা নিজেদের হাতে রাখা।
আইএমএফের ঋণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যেকোনো সংস্কারই কষ্টের। বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্তই নিচ্ছেন। ডলার সংকটের কারণেই বিপদে পড়েছে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানসহ অনেক দেশ। কাজেই চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। কোনো কিছুই রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে না, এজন্য ধৈর্য প্রয়োজন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বের কোথাও গণতন্ত্র একেবারে পারফেক্ট নয়। গণতন্ত্রের মূল কথা জবাবদিহিতা। মানুষ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। সেজন্য নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য। আর প্রত্যাশিত তেমন নির্বাচনের জন্য চলমান সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। এজন্য সংলাপ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, মানুষ সংঘাত-সহিংসতা চায় না, তারা চান অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তা নাহলে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিলে সেখানে উগ্রবাদের উত্থান ঘটতে পারে, যেটি কারও জন্যই মঙ্গলকর নয়। শমশের মবিন বলেন, বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির শিকার। রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের বড় সমস্যা। কূটনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে।
আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নাহিম রাজ্জাক বলেন, অতীতে দফায়-দফায় গণতন্ত্র আমরা কীভাবে হারিয়েছি সেটাও আলোচনার বিষয়। মানুষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়-তাতে সন্দেহ নেই। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধীরা তাদের অবস্থান থেকে কথা বলছেন, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে কথা বলছি। কিন্তু, জনগণই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর নির্বাচনে আমলাতন্ত্রের সংযুক্তির বিষয়ে যে সমালোচনা কেউ কেউ করলেন, সেটির জবাবে বলবো-এটা নির্বাচন প্রক্রিয়ারই অংশ।
নাহিম বলেন, শুধু রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কথা বললেই হবে না, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর দিকেও আমাদের ফোকাস থাকতে হবে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিও আমাদের এখানে একটা সংকট। এছাড়া চলমান বিশ্বমন্দা এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। সেখানে শক্তি পছন্দের ক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাগ্রে আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে জাতীয় স্বার্থকে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ ও সেগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনাও গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ তার বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে গণতন্ত্রের জন্য কাজ করতে হচ্ছে। এখানে চলছে উত্থান-পতনের গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিনের নয়, শুধু ভোটের দিনের গণতন্ত্র নয়। এটা প্রতিদিনের চর্চার বিষয়।
তিনি বলেন, কার্যকর সংলাপের মাধ্যমে প্রয়োজনে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় সংস্কার আনা যেতে পারে। সেটি ভিন্ন নামেও হতে পারে। মোট কথা, নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
সঞ্চালকের দায়িত্ব পালনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন উপসংহার টেনে বলেন, আমাদের নানাবিধ সমস্যা আছে। এরপরেও আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। সামাজিক উন্নয়নে আমরা এগোচ্ছি। পদ্মা সেতুসহ অহংকার করার মতো অনেক অর্জনই আমাদের সামনে দৃশ্যমান। শুধু রাজনীতি কিংবা নির্বাচন-ই একমাত্র ইস্যু হতে পারে না। বরং জাতীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে অধিক মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, ভূ-রাজনীতিও আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। নির্বাচনও এখন ভূ-রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। সমস্যার সমাধান শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকেও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রকাশক তারিন হোসেন বলেন, বিশ্বের কম-বেশি প্রতিটি দেশই গণতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করছে। এটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে বহু বহু বছর লেগেছে।