রাজশাহীর বাগমারায় চিহ্নিত ‘রাজকার’র নাম বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অর্ন্তভূক্তির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকালে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরইউজে) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন ক্ষুব্ধ বাগমারার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরা।
অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন গাইনের নাম সরকারি গেজেট (বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা) থেকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত তদন্তের মাধ্যমে বাদ দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন মিলমালত। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে ওসমান আলী, আব্দুস সালাম, ইউসুফ আলী খন্দকার বুলবুল এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান খোদা বক্স, ফজুলর রহমান, জনাব আলী ও আজাজুল ইসলাম প্রমুখ উত্থাপিত লিখিত বক্তব্য সমর্থন করেন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিমধ্যে অর্ধশতক পেরিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবন দিয়ে আমাদের পতাকা ও মানচিত্র উপহার দিয়েছেন। একটানা প্রায় ১৫ বছর স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন রয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগেরই একজন সংসদ সদস্যের ডিও লেটার ও সাক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, পাকবাহিনীর দোসর, বাগমারায় যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল হোসেন মৃধাসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগকারী চিহ্নিত রাজাকার ইসমাইল হোসেন গাইনকে সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেটে (বেসামরিক গেজেট নম্বর-২২৬৩) অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। যা স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর। এনিয়ে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমরা অবিলম্বে কুখ্যাত রাজাকার ইসমাইল হোসেন গাইনের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বাগমারার শ্রীপুর গ্রামের মৃত মকিম উদ্দিন গাইনের ছেলে অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন গাইন রাজাকার বাহিনীর প্রধান ইব্রাহিম হোসেনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। তবে বাগমারায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ইসমাইল হোসেন মৃধা। ওই সময়ে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে ইসমাইল গাইন, ইয়াসিন ও ইসাহাক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ইসমাইল হোসেন মৃধার বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। অভিযুক্তরা, মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে ময়েজ উদ্দিন, মছির উদ্দিন গাইন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শমসের উদ্দিন, ইউসুফ বকসের বাড়িতেও হামরা, ভাংচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া তারা বাগমারার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করে। ইসমাইল হোসেন গাইন এবং তার সহযোগীদের ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগমারার মানুষ তটস্থ থাকতো।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন গাইনের ছেলে জিল্লুর রহমান স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য (রাজশাহী-৪) এনামুল হকের মিডিয়া কর্মকর্তা থাকার সময় ২০২১ সালের ১৫ জুন বাগমারা উপজেলার যাচাই-বাছাই কমিটি রাজাকার ইসমাইল হোসেন গাইনের নাম জামুকায় (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বাগমারার শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা, যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত উপজেলা কমিটির সদস্য সচিব ও ইউএনও এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ পেয়ে গত বছরের ১৬ জুন স্থানীয় নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্থ মুক্তিযোদ্ধা এবং পরিবারের সদস্যসহ অভিযুক্ত ইসমাইল গাইনকেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ঢাকায় ডাকেন। সেখানে মন্ত্রী উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানিতে ইসমাইল হোসেন গাইনের স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সময় মন্ত্রী অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বাগমারার ইউএনওকে নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশে তৎকালীন ইউএনও ফারুক সুফিয়ান অভিযোগ তদন্তের অংশ হিসেবে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আলী খাজা এমএ মজিদসহ এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করেন। নির্যাতিতরা ইসমাইল হোসেন গাইনের স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ড লিখিতভাবে জানান। কিন্তু প্রতিবেদন দেওয়ার আগ মুহূর্তে ইউএনও ফারুক সুফিয়ানকে আকস্মিকভাবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলায় বদলি করা হয়। তখন তদন্তের গতিও থেমে যায়। পরে নতুন ইউএনও সাইদা খানম তদন্ত রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। অথচ ইউএনও সাইদা খানমকে বাগমারার যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী খাজা এম এ মজিদ তার সাক্ষ্যে বলেন, ইসমাইল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে- কী না সেটি আমার জানা নেই। আমি তাকে চিনতাম না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডেপুটি কমান্ডার খয়বার হোসেন বলেন, আমি ইসমাইল হোসেন গাইনকে চিনি না এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেখেননি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় প্রশিক্ষক দীপপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ বলেন, ইসমাইল হোসেন গাইন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি প্রশিক্ষণেও অংশ নেন নি। এছাড়াও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়ানুচ আলীও লিখিতভাবে বলেন, ইসমাইল হোসেন গাইন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেন। একইভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান আলী, আব্দুস সালাম, ইউসুফ আলী খন্দকার বুলবুল ও আব্দুল খালেক শাহানও বলেন, যুদ্ধের সময় ইসমাইল হোসেন গাইন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন মিলমালত বলেন, এত কিছুর পরও অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন গাইনকে ডিও লেটার (চাহিদাপত্র) দিয়েছেন বাগমারার সংসদ সদস্য এনামুল হক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জামুকায় শুনানির ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত হলে কর্মকর্তারা জানান, সংসদ সদস্য এনামুলের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করে ফিরে আসেন।
রাজাকারকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ডিও লেটার প্রদানের গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে বাগমারার সংসদ সদস্য এনামুল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি কোনো রাজাকারকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ডিও লেটার দেই নি।
নিজের সাবেক মিডিয়া কর্মকর্তা জিল্লর রহমানের পিতা ইসমাইল হোসেন গাইনের নাম উল্লেখ করলে সংসদ সদস্য এনামুল হক বলেন, আমার ডিও লেটারেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হননি। তিনি (ইসমাইল গাইন) আগেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ছিলেন। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের সময় থেকে তাকে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
তবে এক প্রশ্নের জবাবে সংসদ সদস্য এনামুল হক দাবি করেন, এখন যারা ইসমাইল গাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তারাও আমার ডিও লেটারে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
এ বিষয়ে মতামতের জন্য অনেক চেষ্টা করেও অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন গাইনের মতামত পাওয়া যায়নি।
তবে তার ছেলে সংসদ সদস্যের সাবেক মিডিয়া কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বিষয়টি যাচাই করছেন। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।