শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

ভুল অপারেশনে জীবন গেল প্রসূতি ও যমজ সন্তানের

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:২৫

ময়মনসিংহে প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় জীবন গেল প্রসূতি রেখা আক্তার ও তার দুই যমজ শিশুর। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নগরীর ব্রাহ্মপল্লি এলাকার পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রেখা আক্তার ১৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। কিডনির পাথর অপারেশনের জন্য বৃহস্পতিবার বিকালে অন্তঃসত্ত্বা রেখাকে ঐ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে রেখার অপারেশন করেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আশরাফুল হক মোল্লা। এ সময় তাকে এনেসথেসিয়া দেন ডা. আরিফ রব্বানী। অস্ত্রোপচার শুরুর পর ওটির (অস্ত্রোপচার কক্ষ) ভেতর থেকে একাধিকবার চিৎকার শুনতে পান স্বজনরা। অজ্ঞান করার পরই পেটের সন্তান দুটি মারা যায়। আর অস্ত্রোপচার শেষে রোগীকে পোস্ট-অপারেটিভ রুমে রেখে ক্লিনিকের চিকিৎসক-কর্মকর্তারা চলে যান।

অভিযোগ উঠেছে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি রেখা ও তার দুই যমজ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)-এর কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. আব্দুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম)-এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক মালিক ও ডাক্তারসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালে ছিল না আইসিইউ সাপোর্ট। কী দুঃসাহস মেডিক্যাল অফিসার হয়ে আইসিইউ সাপোর্ট না থাকা ক্লিনিকে কিডনির পাথর অপারেশন করলেন। এই প্রশ্ন এখন সবার মধ্যে। অথচ ময়মনসিংহে রয়েছে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, যেখানে আইসিইউসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। রাজধানী ও ঢাকার বাইরের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবার নামে মরণ ফাঁদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে। আর যারা বেঁচে যাচ্ছেন তারা শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন অনেক রোগী আসছেন, যারা ঢাকার বাইরে জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে নানা জটিলতা নিয়ে আসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আগত রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগ অপারেশন ও চিকিৎসা ভুল। আর এই ভুল চিকিৎসায় বেঁচে গেলেও নানা শারীরিক জটিলতা নিয়েই তাদের জীবন অতিবাহিত করতে হয়। ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন হয় ত্রুটিপূর্ণ। এতে মা-সন্তান উভয়েরই বেঁচে থাকতে হয় নানা জটিলতা নিয়ে। এ সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগেরই কোনো লাইসেন্স নেই।

দেশে অনেক ভালো ডাক্তার আছেন। সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা আছে। নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালে ভালো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক আছে, যাদের সেবার মান নিম্নমানের। নানান শ্রেণির ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যের জন্য চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। বাসাবাড়ি কিংবা গুদাম ঘর ভাড়া করে ক্লিনিক ব্যবসা করছেন। ভেতরের পরিবেশ জরাজীর্ণ, বাথরুমগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। মোট কথা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কোনো ধরনের পরিবেশ নেই সেই সব হাসপাতাল-ক্লিনিকে। তাও চলছে বছরের পর বছর। এ যেন দেখার কেউ নেই। এক শ্রেণির অতিলোভী মানুষ চিকিৎসাসেবাকে আদম ব্যবসার মতো বানিয়ে ফেলেছেন। এই ধরনের অব্যবস্থাপনা ও অবৈধভাবে পরিচালিত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, এগুলো দেখার জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু তারাও কাজ করে না। জেলায় যত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো দেখভালের দায়িত্ব সিভিল সার্জনের। পুরো বিভাগের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের। তার ওপরে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়। অথচ এই বিভাগগুলোর দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে প্রতিদিন কত মানুষ যে মারা যাচ্ছে তার হিসাব কেউ রাখে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, আসলে যতই বলি, আইন প্রণয়ন, জেল জরিমানা করেও কোনো লাভ হবে না। কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের যদি নৈতিকতা না থাকে। এখানে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থাকতে হবে। তাকে মনে করতে হবে যাকে সেবা দিচ্ছি তিনি আমার মা-বোন-পিতা-মাতার মতোই। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তান হিসেবে যে ধরনের দায়িত্ব পালন করি, সেই সেবা চাওয়া মানুষের সঙ্গে সেই ধরনের সেবা দেওয়া উচিত। মানুষের সেবা করার সুযোগ সবার হয় না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন চিকিৎসকদের এই সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সেই চিকিৎসকদের কাছ থেকে এই ধরনের আচরণ আমাদের জন্য খুবই দুঃখনক। 

আমাদের ময়মনসিংহ সংবাদদাতা জানান, রেখা আক্তারের স্বামী মাহবুল আলম অভিযোগ করেন, আমার স্ত্রী ১৫ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অস্ত্রোপচার শুরুর পর ওটির (অস্ত্রোপচার কক্ষ) ভেতর থেকে একাধিকবার চিৎকার শুনতে পাই। এর কারণ জানতে চাইলে এক জন নার্স বলেন, অজ্ঞান করার ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। তাই, এমন চিৎকার করছেন। অস্ত্রোপচার শেষে রোগীকে পোস্ট-অপারেটিভ রুমে রেখে সবাই চলে যান। পরে রাত ৩টার দিকে আমি পোস্ট-অপারেটিভ রুমে গিয়ে রেখার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নার্সকে বিষয়টি জানাই। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে রেখাকে শহরের চুরখাইয়ে অবস্থিত বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ না রাখায় ফের অ্যাম্বুলেন্সে করে যমজ সন্তানসহ রেখাকে পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

এদিকে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রতিবাদে হাসপাতালের সামনে মরদেহ রেখে শুক্রবার সকালে বিক্ষোভসহ প্রতিবাদ জানান স্বজনেরা। বিষয়টি জানাজানি হলে হাসপাতালের চারপাশে লোকজন জড়ো হয়। এ সময় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাসপাতালে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান। খবর পেয়ে পুলিশ এসে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়।

পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, অস্ত্রোপচার কোন চিকিৎসক করেছেন তা আমার জানা নেই। রোগীর লোকজন বিষয়টি বলতে পারবেন। আমি ঢাকায় আছি। সেখান থেকে ফিরে বিস্তারিত জানানো যাবে।

এ বিষয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি (তদন্ত) ফারুক হোসেন বলেন, পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা নারীর কিডনিতে পাথর অপারেশন করার পর মারা গেছেন বলে নিহতের পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেছে। তারা মামলা করেছে।

ইত্তেফাক/ইআ