শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উত্তপ্ত পশ্চিম তীর

আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:১৭

অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অভিযানের সময় অন্তত ১১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং আরও অনেককে আহত করেছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য বিভাগ। বুধবার(২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে পশ্চিম তীরের প্রাচীন শহর নাবলুসে  ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশর সময় ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের সাথে  সংঘর্ষ হয়।সেসময় ব্যাপক বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। খবর বিবিসি। 

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, অভিযানে একটি বাড়িতে আত্মগোপনে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীর তিনজন সদস্যকে হত্যা করেছে, যারা আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল।

তবে এর বাইরেও বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুজন বৃদ্ধও আছেন।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৭২ বছর বয়সী আদনান সাবে বারা তাদের একজন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, এক ব্যস্ত বাজারের মধ্যে রাস্তায় থাকা রুটির বস্তার পাশেই তার নিথর দেহটি পড়ে আছে।

এছাড়া ৬১ বছর বয়সী আবদুল হাদী আশকর এবং ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর, মোহাম্মদ শাবানকে গুলি করে মারা হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এছাড়া আনান শাওকাত আনাব নামের ৬৬ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের শ্বাসনালীতে টিয়ার গ্যাস ঢুকে গেলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং বুধবার সন্ধ্যায় মারা যান । লায়ন'স ডেন ও আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর মোট ৬ সদস্য এই অভিযানে মারা গিয়েছে বলে এক টেলিগ্রাম পোস্টে জানিয়েছে লায়ন'স ডেন বাহিনী।

এই অভিযানে মৃতের সংখ্যা গতমাসে ইসরায়েলি বাহিনী জেনিনে যে অভিযান চালায় তার থেকে একজন বেশি। অথচ সেটিই ছিল ২০০৫ সালের পর পশ্চিম তীরে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা।

এই অভিযান যে কারণে আলাদা সেটা হলো এখানে আহত হওয়া লোকের সংখ্যা ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ৮০জনের বেশি, যারা গুলিবিদ্ধ হবার পর এখন নাবলুসের পাঁচটি আলাদা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ফিলিস্তিনের সিনিয়র কর্মকর্তা হুসেইন আল শেখ এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে এটিকে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন।

অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র জানিয়েছে তারা এই ভয়াবহ আক্রমণের জন্য ইসরায়েলি সরকারকে দায়ী করে, যারা এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়াচ্ছে এবং একসময় এটির ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে । 

গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, 'আমরা পশ্চিম তীরে আমাদের লোকদের উপর শত্রুদের এমন ক্রমবর্ধমান অপরাধ পর্যবেক্ষণ করে চলেছি এবং আমাদের ধৈর্য্য ফুরিয়ে আসছে।' 

এই পুরো অভিযানটি ৪ ঘণ্টা ধরে চলে এবং সকালের মাঝামাঝি এমন একটা সময়ে এটি করা হয়, যখন এই প্রাচীন শহরের সংকীর্ণ রাস্তাগুলিতে মানুষ তাদের পরিবার নিয়ে কেনাকাটা করছিল।

এখানকার অধিবাসী খলিল শাহীন বিস্ফোরণের শব্দে জেগে ওঠেন।

তিনি বলেন,'আমি জানালা দিয়ে তাকাই দেখি বিশেষ বাহিনী তাদের প্রশিক্ষিত কুকুর সঙ্গে এনেছে, তার টানছে সম্ভবত বিস্ফোরক প্রস্তুত করতেই, আল্লাহ জানে।' 

ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) বলছে, ফিলিস্তিনরা গুলি চালালে তারা তাদের অপারেশনের সীমা বাড়ায়। যেখানে ঐ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা লুকিয়ে ছিল সেই ভবন লক্ষ্য করে তারা বহনযোগ্য মিসাইল ছোঁড়ে, এতে ভবনটি আংশিক ধসে পড়ে।

'আমরা হুমকিটা দেখেছি এবং আমাদের সেখানে গিয়ে কাজটা সম্পন্ন করতে হয়েছে',  সাংবাদিকদের বলেন আইডিএফের মুখপাত্র ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল রিচার্ড হেশ্ট।

কিন্তু ফিলিস্তিনদের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায় তরুণ-যুবক, যাদের কাছে কোন অস্ত্র নেই তারা পালাতে গিয়ে গুলির শিকার হন এবং একজন গুলির শব্দের সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেও দেখা যায়।

আইডিএফ বলছে ভিডিওটি 'সমস্যাজনক' এবং তারা ভিডিওটি পর্যালোচনা করে দেখছে।

ইসরায়েল দাবি করে ভবনে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীর একজন মোহাম্মদ জুনাইদি, যিনি ফিলিস্তিন ইসলামিক জিহাদের কমান্ডার এবং অন্যজন সিনিয়র সদস্য হুসাম ইসলিম। এছাড়া তৃতীয় সদস্য ওয়ালিদ দিখাইল গত অক্টোবরে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে হামলা চালিয়ে এক ইসরায়েলি সেনাকে হত্যার সন্দেহভাজন।

এছাড়া আরও দুই সন্দেহভাজনকে গত সপ্তাহে নাবলুস থেকে আটক করে আইডিএফ।

অভিযানের সময় ইসলিমের রেকর্ড করা একটি হোয়াটসঅ্যাপ অডিও বার্তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে তাকে বলতে শোনা যায়,'আমরা বিপদে পড়েছি, কিন্তু আমরা আত্মসমর্পণ করবো না। আমি শহীদ হিসেবে মরতে চাই'।

এ মাসের শুরুর দিকে ইসলিমের বাড়িতে ইসরায়েলি বাহিনী অভিযান চালিয়ে তার পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর ইসলিমের বাবা ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান ইসরায়েলি বাহিনী বলছে তার ছেলেকে ধরা দিতে অথবা তাকে হত্যা করা হবে।

ইসলিম ও জুনাইদি দুজনই লায়ন'স ডেনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন-এই গোষ্ঠী গত বছর নাবলুসে ফিলিস্তিনের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সুযোগে তাদের প্রভাব বিস্তার করে।

পার্শ্ববর্তী শহর জেনিনে অনেকটা একইরকম আরেকটা সংগঠন, টিকটক ও টেলিগ্রাম ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মকে অস্ত্রহাতে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছে।

ইসরায়েলি বাহিনী এই দুটি শহরেই অনুসন্ধান, আটক এবং এরকম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে যার লক্ষ্য তারা বলছে ইসরায়েলের বিপক্ষে ভয়াবহ আক্রমণ প্রতিহত করা।

সবমিলিয়ে এমন অভিযানে এই বছরে বেসামরিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলিয়ে ৬০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হল। এছাড়া ইসরায়েলিদের লক্ষ্য করে ফিলিস্তিনিদের হামলায় ১১জন মারা যান।

আর বুধবার নাবলুসের এই রক্তক্ষয়ী অভিযান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চলমান সেটা আসলে ব্যর্থ হচ্ছে।

ইত্তেফাক/এফএস