মানবিক অধিকারের স্বীকৃতি, সাম্য এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে ইসলামের মহান শিক্ষায় এ সত্য প্রতিফলিত হয় যে, কোনো মানুষ অপর মানুষকে যেন নীচ ও ঘৃণ্য মনে না করে, বরং নিজের বংশগত মর্যাদা, পরিবার, অথবা ধন-সম্পদ ইত্যাদির ভিত্তিতে গর্ব না করে। কেননা, এগুলো প্রকৃত গর্বের বিষয় নয়। এমন গর্বের কারণে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ইসলামের শিক্ষা হলো সব মানুষ একই আদি পিতা-মাতার সন্তান হওয়ার দিক দিয়ে ভাই ভাই এবং পরিবার, গোত্র অথবা ধন-দৌলতের দিক দিয়ে যে প্রভেদ আল্লাহ তা’আলা রেখেছেন, তা গর্বের জন্য নয়, পারস্পরিক পরিচয়ের জন্যে।
আল কুরআনে ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক হক, আদব ও সামাজিক রীতিনীতি নির্দেশ করা হয়েছে, ‘তাদের অধিকাংশ অনুমানেরই অনুসরণ করে। সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোনো কাজে আসে না। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’। (১০ সংখ্যক, সুুরা ইউনুস, আয়াত ৩৬) ‘তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ইমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। হে মুমিনগণ! তোমরা বহুবিধ অনুমান করা থেকে দূরে থাক। কারণ অনুমান কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না’। (৪৯ সংখ্যক সুরা হুজুরাত, আয়াত ১১-১২)। আয়াতগুলোতে—(১) অনুমান করা; (২) কারো গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা; (৩) কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা; (৪) কাউকে দোষারোপ করা এবং (৫) কারো পশ্চাতে নিন্দা করা বা গিবতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুমান বা ধারণা করা থেকে বিরত থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে কতক ধারণা পাপ। প্রত্যেক ধারণাই পাপ নয়। অতএব কোন ধারণা পাপ তা জানা জরুরি, এটা সাব্যস্ত করতেই সাবধানতা অবলম্বনের এ নির্দেশ। কুরতবী তার তফসিরে লিখেছেন—নিষিদ্ধ ধারণা বলতে এক্ষেত্রে অপবাদ বোঝানো হয়েছে। অর্থাত্ কোনো ব্যক্তির প্রতি শক্তিশালী প্রমাণ ব্যতিরেকে কোনো দোষ আরোপ করা।
কারো গোপনীয় বিষয় বা দোষ অনুসন্ধান প্রসঙ্গে ভাষ্য এই যে, যে দোষ প্রকাশ্য, তা ধরা যায়, কিন্তু যে দোষ প্রকাশ্য নয়, তা সন্ধান করা জায়েজ নয়। হাদিস শরিফে আছে রাসুল (সা.) বলেছেন ‘মুসলমানদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে নিজ গৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন’। কাউকে ঠাট্টা বা উপহাসের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির দেহে, আকার-আকৃতিতে কিংবা কর্মকাণ্ডে কোনো দোষ দৃষ্টিগোচর হলে তা নিয়েও কারো হাসাহাসি বা উপহাস করা উচিত নয়। কেননা এটা হয়তো জানা নেই যে, এই ব্যক্তি সততা, আন্তরিকতা ইত্যাদির কারণে আল্লাহর কাছে উপহাসকারীর চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে রাসুলে করিম (সা.)-এর একটি হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখ্য—‘আল্লাহ্ মুসলমানদের আকার-আকৃতি ও ধন-দৌলতের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না, বরং তাদের অন্তর ও কাজকর্ম দেখেন’। কারো দোষ বের করা, দোষ প্রকাশ করা এবং দোষের কারণে তিরস্কার করাকে আত্মঘাতী প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একে অপরের প্রতি দোষারোপকে একে অন্যকে হত্যা করার সঙ্গে সমার্থক আকারে প্রকাশ করার রহস্য—এ কথা বলা যে, অপরকে হত্যা করা যেমন নিজেকে হত্যা করার শামিল, তেমনি কেউ অন্যের দোষ বের করলে সে-ও তার দোষ বের করবে। পারস্পরিক দোষারোপের ফলে শক্রতা বৃদ্ধি পায়, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টি হয়। সুস্থ ও সম্মানজনক সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে এক দুঃখজনক প্রতিবন্ধকতা।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান, এনবিআর