সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রচারণা চালু করেছে। ক্যাশলেস নামক বিপ্লবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বর্তমান চিত্র দেখলে আমরা ভবিষ্যৎ ডিজিটাল বিশ্বের রূপ সম্পর্কে ধারণা পেতে সক্ষম হব। মার্কেট মার্চেন্টের বিশ্লেষণকৃত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৫৪টি দেশ সম্পূর্ণ ক্যাশলেস হওয়ার পক্ষে আছে আর ৩২টি দেশ এখনো নগদ অর্থের মাধ্যমে বিনিময় করতে চায়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সবচেয়ে বেশি ক্যাশলেস লেনদেন করা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, আগামী বিশ্ব নগদ টাকা ছেড়ে ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এজন্য ক্যাশলেস অর্থনীতি বা ক্যাশলেস সোসাইটি আলোচনা বহুদিন ধরে চলে আসছে একাডেমিক পর্যায়ে। ক্যাশলেস সোসাইটি বা সমাজের অন্যতম দৃষ্টান্ত বর্তমানে নর্ডিক দেশ সুইডেন, যেখানে এখন নগদ অর্থের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলা চলে, মাত্র ১০ শতাংশের কমসংখ্যক মানুষ এখন ক্যাশ ব্যবহার করে। একই পথে হাঁটছে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কে প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ এখন ক্যাশলেস ব্যবস্থার আওতায় চলে গেছে। বিশেষজ্ঞের মতে, সুইডেন হয়তো পৃথিবীর প্রথম দেশ হবে যারা কিনা সম্পূর্ণ ক্যাশলেস সোসাইটিতে রূপান্তরিত হবে। এর মধ্যে ক্যাশলেস পেমেন্টের পথিকৃৎ রূপে পরিচিত চীন তাদের দেশের আলি পে, উইচ্যাট পে, টেনসেন্ট মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে বহু আগের মোবাইল পেমেন্ট দিয়ে ক্যাশলেস যাত্রা চালু করেছিল। কোভিডের পরবর্তী সময়ে চীন তাদের প্রথম জাতীয় ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি করেছে। চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ স্পর্শবিহীন ক্যাশলেস লেনদেন রূপান্তরের কাজে রয়েছে। এ বছর চীনের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন করবে বলে আশা করছে দেশটি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ডিজিটাল লেনদেনের বাস্তবিক প্রয়োগের বড় দৃষ্টান্ত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। চলতি বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ভারতের কেন্দ্রীয় আইটি, টেলিকম ও রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, গত বছর ভারতের ডিজিটাল পেমেন্ট লেনদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সের সম্মিলিত ডিজিটাল পেমেন্টের চেয়ে বেশি ছিল।
মূলত ক্যাশলেস ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির বিকাশের একটা নতুন অধ্যায়। ক্যাশলেস ব্যবস্থা ব্যবহারের অনস্বীকার্য অনেক সুবিধা আছে যেমন ক্যাশলেসের ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোনো সময়, জায়গা থেকে সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা যায়, ক্যাশলেস ব্যবস্থায় টাকা তৈরির খরচ কম আসে, অতিরিক্ত টাকা সঙ্গে না রাখার জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়, আর্থিক অপরাধ সংখ্যা কমে যায়। এ ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাবনা নেই, প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড রাখা সম্ভব, নকল বা জাল টাকার জালিয়াতি থেকে সুরক্ষিত, হাতে ধরা টাকা-পয়সার আদান-প্রদান বন্ধ হওয়ার কারণে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ কম থাকে এবং সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব নগদবিহীন লেনদেন ব্যবস্থায় বিশ্বে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে সহায়তা করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী ধাপ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করল সরকার। সেই উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্যাশলেস বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর সূচনা করে। সর্বসাধারণকে কিউআর কোডের পেমেন্টসহ সব ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সম্পর্কে জানাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রচারণার স্লোগান—‘সর্বজনীন পরিশোধ সেবায় নিশ্চিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ’। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে মতিঝিল এলাকায় চা-দোকান, মুদি দোকান, হোটেল, মুচিসহ ভাসমান বিক্রেতাদের কিউআর কোড সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ১০টি ব্যাংক, তিনটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম এই কাজে প্রাথমিকভাবে যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে এ উদ্যোগে যেসব ব্যাংক সম্পৃক্ত করা হয়, সেগুলো হলো—ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট এবং আন্তর্জাতিক পরিশোধ স্কিম মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এ সেবায় যুক্ত হয়েছে। শুরুতে ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে নগদ লেনদেনমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রান্তিক থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীকে এই সেবার আওতায় আনা হয়েছে। শিগগিরই বিভিন্ন বিভাগীয় শহরকে এর আওতায় আনা হবে। পর্যায়ক্রমে এই সেবা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
স্পর্শবিহীন মূল্য পরিশোধ পদ্ধতির কারণে, করোনা মহামারি চলাকালে বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিংসেবা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে ১১ হাজার ২৯টি সম্পূর্ণ অনলাইন ব্যাংক শাখা, ১৩ হাজারের বেশি এটিএম বুথ, ১ হাজার ২২১টি ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন এবং ২ হাজার ২৫৬টি ক্যাশ রিসাইক্লার মেশিন রয়েছে। বিভিন্ন মার্চেন্ট পয়েন্টে পস টার্মিনালের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৮। দেশে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডেবিট, ক্রেডিট এবং প্রিপেইড কার্ড গ্রাহক রয়েছে। ৬০ লাখেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং গ্রাহক রয়েছে। মোবাইল আর্থিক সেবা গ্রাহক রয়েছে অনেক। তাছাড়া ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি গ্রাহক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছেন। প্রতি বছর এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। ক্যাশলেস সেবা নিতে বা পেতে শুধু একটা ব্যাংকের অ্যাপ থাকলেই চলবে। অ্যাপে বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে সব ব্যাংকের গ্রাহক পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন।
‘ক্যাশলেস ইকোনমি’ বা নগদবিহীন অর্থনীতির বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। নগদমুক্ত ডিজিটাল লেনদেন প্রক্রিয়ায় দ্রুত লেনদেন করা যায়, এটি নগদ টাকা বহনের খরচ এবং সময় অপচয় কমায় এবং দ্রুত আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়। এছাড়া এই ব্যবস্থা রাজস্ব সংগ্রহে সহায়তা করে, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং অপরাধ হ্রাস করতে সহায়তা করে।