রোববার, ২৬ মার্চ ২০২৩, ১১ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

থিরবিজুরি

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৩, ১১:৫৮

‘মা ঝেমাঝে আমার মনে হয় কী, জানো?’ পনেরো তলা উঁচু দালানের ছাদের রেলিংয়ের বাইরে নিজের অর্ধেক শরীর ঝুঁকিয়ে দিয়ে মেয়েটা প্রশ্ন করে অদূরেই দুরুদুরু বুকে দাঁড়ানো ছেলেটাকে।

মেয়েটা যা করছে, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখান থেকে কোনোক্রমে ছিটকে একবার নিচে পড়লে কী হবে—তা সে চিন্তাও করতে পারে না।

‘মাঝরাতে, কিংবা শেষরাতে, যখন আমার করার কিছুই থাকে না, ঘুমও আসে না চোখে, মন চায় আমাদের এই বিল্ডিংয়ের লিফটে করে সোজা আকাশে চলে যেতে। কিন্তু লিফটটা ছাদে এসেই থেমে যায়। তখন আমি চুপচাপ ছাদের মাঝখানটায় এসে বসে থাকি। একপর্যায়ে...’

‘একপর্যায়ে?’

‘একপর্যায়ে মনে হয়, ছাদের রেলিংয়ের ঐ পাশটা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই, রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে দেখতে থাকি রাতের ঢাকা শহর। সবার চাইতে আপন মনে হয় বহুদূরের ঐ কংক্রিটের রাস্তাকে। আমার ওকে ছুঁয়ে দেখতে মন চায়, মন চায় জড়িয়ে ধরতে।’

সাদা পাঞ্জাবি পরেছে আজ মেয়েটা, সঙ্গে নীলরঙা ডেনিমের জিন্স। ওড়না বাতাসে উড়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তুলে সেটা আবার গলায় জড়াতে হবে—এমন কোনো তাড়াহুড়ো নেই ওর মধ্যে। বাসন্তী রঙের ওড়নাটা ছাদের যে প্রান্তে পড়ে আছে, পুরোটা জায়গা রঙিন হয়ে আছে, যেন কাপড় নয়, গেরুয়া রঙের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে রাখা ওখানটায়। খুলে রাখা কোঁকড়া চুল বাতাসে বারবার ঝাপটা দিচ্ছে মুখের ওপর। ওর চোখে দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটা, মেয়েটার ঐ চোখ দেখতে চাচ্ছেও না আসলে। ঐ বিষণ্ন চোখের গভীরতা সামলানো মুশকিল।

‘আমি ঝাঁপ দেই না কেন জানো? আমার তোমার কথা মনে পড়ে এমিল।’

ছেলেটা নির্বাক। এ সময়ে কথা বলতে হয় না। এ সময়ে তার কথা বলার অনুমতি নেই। নিস্তব্ধতা—কী অদ্ভুত এক বস্তু! একেক মুহূর্তে কী বৈচিত্র্যময় অর্থের দ্যোতনা তৈরি করে সে।

‘কিছুই বলবে না? তোমার কিছুই বলার নেই এমিল?’

বিকেলবেলার সূর্যের আলো তাদের দুজনের মুখেই সমানভাবে ঠিকরে পড়ছে। ছেলেটা খুব ধীরে, প্রায় নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে তার কত কথার ঝড়, কিন্তু সে জানে, বলা যাবে না কিছুই। মুখে সে জবাব দেয়, ‘জবরদস্তি করে সম্পর্ক হয় না অরিন। হলেও, সে সম্পর্ক টেকে না।’

‘আমি বাঁচি কি মরি, তাতেও তোমার কিছুই যায় আসে না, তাই না? আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা-মন্দলাগার কোনো দাম নেই তোমার কাছে? আমার কথা শুনতেও বুঝি ভালো লাগে না তোমার? পছন্দ করো না সেটা ভিন্ন বিষয়, তাই বলে ফোনও ধরবে না?’

‘কথা শুনতে ভালো লাগে না?’—মনে মনে হাসে ছেলেটা। কীভাবে মেয়েটাকে বোঝাবে সে, যদি সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষের বাকশক্তি রহিত হয়ে যায়, তবুও, পৃথিবী ধ্বংসের আগমুহূর্ত পর্যন্ত সে বসে বসে কেবল মেয়েটার কথা শুনতে পারে। যদি সে কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে যে পৃথিবীর সব শিশু আইবুড়ো হয়ে বসে আছে, তবুও সে সতেজ থাকবে কেবল এই কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটার ছেলেমানুষিতে।

ছেলেটা মাথা নিচু করে। মনে যে সব কথা ঘুরতে থাকে, তা বলা যায় না কেন সোজাসাপটাভাবে?

মেয়েটার চোখ থেকে বিষণ্নতা কেটে যায় আস্তে আস্তে। সেখানে ফুটে ওঠে বিস্ময়। কিছু পর, তাতে গিয়ে মেশে কৌতুক। ছেলেটার জল টলমল চোখ মেয়েটির ডাগর চোখের অবিশ্বাস, কৌতূহল, কৌতুক এবং অবজ্ঞার মিশ্রণ সইতে পারে না। ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণের তাপে পাহাড় চূড়া থেকে গলে পড়া জলের মতো টুপ করে দু’ফোঁটা অশ্রু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

‘রনি ভাই! আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কাঁদে কেন? এটা কি কান্নার সিন?’

মেয়েটা দমকা হাসিতে ফেটে পড়ে ক্যামেরার সামনে থেকে সরে আসে।

ছেলেটা দ্রুত মাথা নিচু করে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে।

‘সরি ম্যাম, ক্যারেক্টারে মিশে গিয়েছিলাম হয়তোবা।’

‘ক্যারেক্টারে মিশে গিয়েছিলা?’ চোখ আবারো বড় বড় করে তাকায় মেয়েটা ছেলেটার দিকে। বলে, ‘রনি ভাই, আপনার পরের নাটকে আপনার এই অ্যাসিস্ট্যান্টকে আমার অপোজিটে কাস্ট করবেন বলে রাখলাম।’

সেটের সবাই হাসিতে ভেঙে পড়ে।

‘আয় ব্যাটা, ক্যামেরার পেছনে আয়। তোর আর ক্যারেক্টারে মেশা লাগবে না, আমার হিরো চলে এসেছে।’

ছেলেটা ক্যামেরার পেছনে আসতে আসতে সিনিয়র অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের ফাজলামোর অংশ হিসেবে একটা লাথি খায় পাছায়। অন্য দিন হলে এরকম দশটা লাথিও তার গায়ে লাগে না, আজ কেন যেন অহমের খুব গহিনে গিয়ে ঘাই মারে পুরো ব্যাপারটা। সেট থেকে একটু দূরে, ছাদের আর এক কিনারায় গিয়ে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে গিয়ে মিশতে থাকে তার সব দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা। পড়াশোনায় অকৃতকার্য হওয়া, বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে ঘর থেকে বের হয়ে আসা, মা আর ছোট বোনের কান্না, এদিক-সেদিক নানাদিক ঘুরে অবশেষে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে নাটকের সেটে ডিরেক্টরের সেকেন্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেওয়া, এবং কপালের এমনই ফের—সেটের নায়িকার একদম হাবুডুবু প্রেমেপড়া। অদূরে, ছাদের আরেক প্রান্তে, যেখানে এখন নাটকের নায়িকা হিরো আর ডিরেক্টরের সঙ্গে প্রাণবন্ত হাসি-আড্ডায় মেতে উঠেছে, কিছুক্ষণ আগে এক মুহূর্তের জন্যেও সেখানে ফুটেছিল তারার ফুল।

ঝিরঝিরে বৃষ্টির পর যে রামধনু দেখা যায় আকাশে, তার একপ্রান্ত এসে মিশেছিল এই ছাদে। সোজাসাপটা গড়ের মাঠের মতো আকাশ, অস্তমিত সূর্যের রাঙা আলোয় সারা পশ্চিমাকাশ উদ্বেল, রঙিন। এরই মাঝে আকাশের একপ্রান্তে কড়কড়িয়ে বজ্রবিদ্যুত্ খেলে গেল বার তিনেক। বৃষ্টির সম্ভাবনাহীন আকাশে এই থিরবিজুরির উপস্থিতির কী কারণ? কী যুক্তি? সে ভেবে পায় না। সিগারেটের ধোঁয়ায় পুনরায় আচ্ছন্ন করে দেয় চারপাশ।

ভাবে, একটা সিনেমা বানাতে হবে শালা!

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন