শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা

আসছে মুখে খাওয়ার ইনসুলিন

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০৬:০২

বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর ছড়াছড়ি। ২০-৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ১০ জনে একজন এখন রোগটিতে ভুগছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৩ কোটি ৭০ লাখ এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে চার জনে তিন জনেরও বেশি ডায়াবেটিসে ভুগছেন।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ কোটি ২০ লাখ। পাঁচ ধরনের সরাসরি এই রোগটিতে ভুগে প্রতি বছর মারা যায় ১৫ লাখ মানুষ। ১৯২১ সালে আবিষ্কৃত ইনসুলিন ইনজেকশনই এখন পর্যন্ত ডায়াবেটিসের সবচেয়ে কার্যকর, নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দিনে কয়েক বার এই ইনসুলিন সুঁইয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করার যন্ত্রণা থেকে দীর্ঘদিন ধরে রেহাই পাওয়ার স্বপ্ন কোটি কোটি ডায়াবেটিসের রোগীর। সাধারণত একে দুটি ভাগে ভাগ  করা হয়—টাইপ-১ এবং টাইপ-২। তবে ২০১৮ সালে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের গবেষকরা জানান, ডায়াবেটিস আসলে পাঁচ ধরনের।

যতো প্রকারের চিকিৎসা

ডায়াবেটিসে একবার আক্রান্ত হলে তা চিকিৎসায় পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা একবার ধরা পড়লে সারা জীবনের জন্য বয়ে বেড়াতে হয়। প্রতিদিন একবার পেটে ইনসুলিন ইনজেকশন, জীবনযাপনে পরিবর্তন ও নানারকম বিধিনিষেধ মেনে চলা সত্ত্বেও রোগটি সারা জীবন ধরে সাথি হয়ে থাকবে এই বিষয়টি খুব পীড়া দেয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে। আগে সুঁই দিয়ে ইনজেকশন দিতে হতো। সেই সুঁই অনেক মোটা ও কষ্টদায়ক ছিল। এখন পেনের মতো ডিভাইস হাতের কাছেই পাওয়া যায়। আবার আগে ইনসুলিন নিয়ে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন এমন ইনসুলিন পাওয়া যায়, যা শরীরে দ্রুত কাজ করে। তাই সঙ্গে সঙ্গেই খাবার খাওয়া যায়। তারপর যেমন প্রতিদিন সুঁইয়ের গুঁতো খেতে কার ভালো লাগে। এখন কিছু ইনসুলিন সপ্তাহে এক দিন দিলেই হয়। ডায়াবেটিসের সঙ্গে শরীরের স্থূলতার অনেক বড় সম্পর্ক রয়েছে। একজন ব্যক্তির ওজন যত বেশি, তার ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও তত বেশি। আর তাতে এক পর্যায়ে ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়। এখন কিছু ইনজেকশন আছে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে আবার একই সঙ্গে ওজন কমায়। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ। যদিও এগুলোর খরচ এখনো বেশি। আর পশ্চিমা বিশ্বে মাসে একবার ইনসুলিন নিতে হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আধুনিক ওষুধের বিকাশের সঙ্গে রোগীদের স্টেম সেল দিয়ে ডায়াবেটিসের একটি নির্দিষ্ট এবং স্থায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। ডিভাইসটির একটি অংশ ডায়াবেটিক রোগীদের শরীরের ত্বকের নিচে লাগানো থাকে। এতে সেন্সর রয়েছে, যা শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বুঝতে পারে এবং সংকেত পাঠাতে পারে। মোবাইল ফোনে সংকেত পাঠানোর ব্যবস্থাও এখন তৈরি হয়েছে। কতটুকু ইনসুলিন দরকার হবে সেই সংকেত চলে যায় যন্ত্রটির আর একটি অংশ ‘ইনসুলিন পাম্পে’। এই পাম্প সঠিক মাত্রার ইনসুলিন ত্বকের নিচে ‘টিস্যুতে’ পৌঁছে দেয়।

গবেষণায় যত অগ্রগতি

ওয়েবসাইট ডায়াবেটিস ডট কো ডট ইউকে জানিয়েছে, মুখে খাওয়ার ইনসুলিন এখন আর স্বপ্ন নয়। বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। গত বছরের মে মাসে ওরামেড ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি কোম্পানি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য প্রথম মুখে খাওয়ার ইনসুলিন ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ শুরু করে এবং সফল হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওরালিস প্রকল্পের সহায়তায় এই ওষুধটি ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় নতুন যুগের উন্মোচন করবে বলে আশা করা হয়। ২০১৮ সালে ব্রিটেনের কার্ডিফ অ্যান্ড ভেলস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক জানান, তারা ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে ইনসুলিন হরমোন উৎপাদন করার সেল পুনরায় তৈরি করতে পারবে এরকম একটি ওষুধ নিয়ে কাজ করছেন। তারাও মানবদেহে ট্রায়ালের কথা জানিয়েছেন। ইনসুলিন হরমোন তৈরি হয় প্যানক্রিয়াসে। আর একটি অগ্রগতি হচ্ছে কৃত্রিম প্যানক্রিয়াস। মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এটি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে।

মুখে খাওয়ার ইনসুলিন খুবই ব্যয়বহুল। বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি এই ইনসুলিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণীর ওপর চালানো গবেষণায় মুখে খাওয়ার ইনসুলিন সফলতা পেয়েছে। ডায়াবেটিস টাইপ-২ এর ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া গেছে। কোন কোম্পানি আগে বাজারে নিয়ে আসতে তা নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। কানাডা ভিত্তিক জেনেরেক্স বায়োটেকনোলজি মুখে খাওয়ার ইনসুলিন তৈরি করেছে। কোম্পানিটি ইকুয়েডরে এ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইনসুলিন তৈরির জন্য মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি ইলি লিলির সঙ্গে চুক্তিও করেছে জেনেরেক্স বায়োটেকনোলজি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোরোমডও যন্ত্রণাবিহীন ইনসুলিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। বায়োটেক কোম্পানি নেকতার টেকনোলজি মুখের ইনসুলিন তৈরির জন্য ফাইজার এবং সানোফি-অ্যাভেন্তিসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। ডেনমার্ক ভিত্তিক নভো নরডিস্কের সঙ্গে মিলে ইনসুলিন তৈরির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছে আরাডিগম করপোরেশন। ভারতের কোম্পানি ওকহার্ট মুখের ইনসুলিন বাজারে আনতে কাজ করছে। মূলত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কে আগে বাজারে মুখের ইনসুলিন আনতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। কারণ বিশ্বে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের ইনসুলিনের বাজার রয়েছে।

ইত্তেফাক/এমএএম