‘অপপ্রচার কাকে বলে? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সত্যকে কেন্দ্র করিয়া মিথ্যার সমান ব্যাসার্ধ লাইয়া যে বৃত্তচাপ আঁকা হয় তাহাকেই অপপ্রচার বলে।’ বাঙালির কাছে তিন ‘গু’-এর কারিশমা অন্যরকম। এই তিন ‘গু’ হচ্ছে– গুল, গুজব এবং গুঞ্জন। বর্তমানে এই সবকিছুরই বাহন হচ্ছে স্যোশাল মিডিয়া। বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ভাগা দেশগুলোর একটি, যেটি দেশি-বিদেশি নানা মিডিয়া ও তথাকথিত ফ্রিল্যান্সারদের অগণিত অপপ্রচারের শিকার, কিন্তু ক্ষমতাসীনদেরতা মোকাবেলার সক্ষমতা নেই। অথচ এই অপপ্রচারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ তারাই। আগামী নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, বিদেশে বসে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তত বেশি গুজব অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা করবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু তা নিরসনে চোখে পরার মতো তেমন উদ্যোগ নেই। সরকার যখন স্মার্ট বাংলাদেশ নামে নতুন একটি রূপকল্পের কথা সামনে আনছে। তখন অপপ্রচার বন্ধে কর্তৃপক্ষের এই নিষ্ক্রিয়তা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পের শতভাগ সাফল্যের ঘোষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ডিজিটালাইজেশনে বাংলাদেশের এত এত সাফল্যের পরও অপরাধীদের আইনানুগ শাস্তির আওতায় আনার বা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার থেকে বিষয়বস্তু মুছে ফেলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি সরকার। অথচ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) প্রকাশিত অবমাননাকর খবর মুছে ফেলার জন্য টুইটার ও ফেসবুককে নির্দেশ দিয়ে উদাহরণ স্থাপনের পথে রয়েছে। কিছু নিউজ পোর্টালের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, ওয়েবসাইটে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এখনো বিদ্যমান প্রোপাগান্ডাগুলিকে ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ সরকারেরও এটি অনুসরণ করা উচিত।
৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ক্ষমতাসীনদের স্বার্থেই দেশে সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে গোটা একটা প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জেনে বেড়ে উঠে, যা ছড়িয়ে পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। তাই বর্তমানে সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে ইতিহাস বিকৃতি করা। যে কেউ নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাসে ভুল ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়ে যেকোনো সম্মানিত ব্যক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলতে পারেন। মূলত এই ডিজিটাল যুগে আমরা যা হারিয়েছি তা হলো- দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, মিডিয়া থেকে খাঁটি ও বিশ্বস্ত তথ্য পাওয়ার অধিকার। সাইবার বিশ্বে অগণিত বিভ্রান্তি, ভুল তথ্য রয়েছে এবং সেগুলো ইউটিউব, ফেসবুক ও টুইটারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই সামাজিক নেটওয়ার্কিং জায়ান্টগুলো বিভ্রান্তি তৈরির জন্য হয়তো দায়ী নয়; কিন্তু জনগণের কাছে বিভ্রান্তির অ্যাক্সেস নিশ্চিত করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে নিন্দিত হচ্ছে। যেমন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে বানোয়াট তথ্যের জন্য বিবিসি সমালোচনার মুখে পড়েছে। জাতি, ধর্ম এবং জাতীয়তা-নির্বিশেষে বিশ্বের অনেক নেতা সংগঠিত ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার শিকার হওয়ার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এমনকি ব্রিটিশ প্রিমিয়ার ঋষি সুনাক ঘোষণা করেছেন যে বিবিসি যেভাবে দেখিয়েছে তার দেখা নরেন্দ্র মোদি এমন নন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউটিউব ও টুইটারে বাংলাদেশ সম্পর্কে আপলোড করা অপপ্রচার ও মিথ্যা বিষয়বস্তু আটকাতে এখন পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? উত্তর হবে 'কিছুই না'! ২০২১ সালের গোড়ার দিকে, আলজাজিরা টেলিভিশন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য সমন্বিত "অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার ম্যান'স" শিরোনামে ডকুমেন্টারি প্রচার করে। এর আগেও নেটওয়ার্কটি আমাদের দেশ, নেতৃত্ব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য এ জাতীয় অসংখ্য ভুল তথ্য প্রচার করেছিল। কিন্তু তা রোধে যুগান্তকারী কোনো পদক্ষেপ চোখে পরেনি। ফলে এখনো এই দেশ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ ধরনের তথ্য আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে।
গতবছরে ২৪ জানুয়ারি আদালতে এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে লন্ডন থেকে সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর পরিচালিত ‘করাপশন ইন মিডিয়া’ নামে ফেসবুক পেজে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ওই পেজে প্রচার করা মানহানিকর ভিডিও অপসারণ চাওয়ার আবেদন ৭ দিনের মধ্যে বিটিআরসিকে নিষ্পত্তি করতে বলেছিলেন আদালত। তাতেও কি এই জাওয়াদ নির্ঝরদের বন্ধ করা গিয়েছে? যায়নি, আজও এই চক্রটি দূর দেশে বসে কুৎসা রটনাতে ব্যস্ত সময় পার করেছে। গত বছর একজন মন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, বিদেশে বসে যারা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা হবে। তাতেও কি খুব বেশি লাভ হয়েছে? মনে হচ্ছে না। এই অপপ্রচারকারীরা স্বপ্ন দেখছেন একদিন তাদের মনোনীত দল ক্ষমতায় আসবে এবং তারা বীরদর্পে দেশে ফিরবেন।
আসলে অপপ্রচার বা গুজব মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলে, মানুষও গুজবের পাখায় ভর করে উত্তেজনার খেলায় মাতে! তাই পরীক্ষার আগে আজও অনেকে ডিম খায় না জিরো পাওয়ার ভয়ে। কেউ খায় জোড়া বা যমজ কলা, যাতে যমজ সন্তান জন্মে। গুজব সম্ভবত সভ্যতার সমান বয়সী। সৃষ্টির শুরু থেকে গুজবটাই ছিল শুধু প্রবহমান তথ্য। গুটেনবার্গ কিংবা ছাপাখানার কারণে হয়ত প্রবহমানতা কিছুটা থেমে যায়। কিন্তু বর্তমানে যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে এই গুজবের সবচেয়ে বড় পীঠস্থান। তাই এই অপপ্রচারকারীদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়। দেশের আইকনদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর এই কনটেন্টগুলো মুছে ফেলার লক্ষ্যে সরকারের উচিত ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া। সরকার এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিবেশী স্টেকহোল্ডার ভারতের কাছ থেকেও সহায়তা চাইতে পারে। তা না হলে, কান নিয়েছে চিলে শুনে, আমরা সবাই কানের খোঁজে ঐ চিলে পেছনে ঘুরেই মরবো।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী