শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

বিরল এসএমএ রোগে বছরে ৩০ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে

আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৩, ০৫:৩৬

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) নামক বিরল রোগে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। কিন্তু এই রোগ শনাক্তকরণ ও গবেষণার কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই। শনাক্ত করতে একটি জেনেটিক ল্যাব দরকার যেটি প্রায় ২ কোটি টাকা হলেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এসএমএ শনাক্ত করার ব্যবস্থা আছে। গবেষণাও রয়েছে ঐ দেশটিতে। জেনেটিক যত রোগ আছে তার সবগুলো শনাক্তকরণের ব্যবস্থা ভারতে রয়েছে। বাংলাদেশের এসএমএ আক্রান্তদের শনাক্ত করতে হয় ভারতে নমুনা পাঠিয়ে। রিপোর্ট পেতে এক মাস লাগে। এটা পরীক্ষা করতে ২০ হাজার টাকা লাগে। তবে পরীক্ষা না করালেও কিছু উপসর্গ দেখে এই রোগ সম্পর্কে চিকিত্সকরা ধারণা করতে পারেন। বিরল এই রোগে আক্রান্তরা জন্মের দুই বছরের মধ্যে মারা যায়। তবে একটি ইনজেকশন দিতে পারলে এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের বাঁচানো সম্ভব। তবে ঐ একটি ইনজেকশনেরই মূল্য ২২ কোটি টাকা। বাংলাদেশের রায়হানসহ বিশ্বে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩০০ শিশুকে দেওয়া হয়েছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের এই ইনজেকশন। যার মধ্যে একজন মারা গেছে। বাংলাদেশের রায়হানসহ বাকি সবাই ভালো আছে। এসএমএ রোগের ইনজেকশন আবিষ্কার করেছে সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি নোভার্টিজ। এটা যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ কর্তৃক অনুমোদিত। দীর্ঘদিন গবেষণার পর এ ওষুধটি আবিষ্কার করা হয়েছে। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, বিশ্বে জেনেটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যেসব বাচ্চা মারা যায় এসএমএ তার শীর্ষে। বিরল এসএমএ রোগ শনাক্তকরণে দেশে জরুরি ভিত্তিতে একটি জেনেটিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তাহলে সামর্থ্যবানরা ইনজেকশনটি ক্রয়ের প্রস্তুতি নিতে পারবে। এমনকি জেনেটিক ল্যাব থাকলে মায়ের পেটে থাকাবস্থায় কোনো শিশু বিরল রোগে আক্রান্ত কিনা তা শনাক্ত করা যেত।   

এসএমএ একটি জটিল জিনগত রোগ। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। তবে তাদের বুদ্ধি সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও জটিলতার কারণে এসব শিশু চিকিত্সা না পেলে জন্মের দুই বছরের মধ্যে মারা যায়। এটা একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার, যেটি মূলত মোটর নিউরণ সংলগ্ন স্নায়ুগুলোকে অক্ষম করে দেয়, ফলে এসব স্নায়ু নিয়ন্ত্রিত মাংসপেশিগুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারায়। সাধারণত শরীরে যেসব মাংসপেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে, খাবার খেতে, বসার সক্ষমতায়, হামাগুড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং সর্বোপরি হাঁটতে পারার জন্য কার্যকরি, এসএমএ আক্রান্ত হলে সেসব পেশি দুর্বল হয়ে যেতে যেতে এক সময় পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যায়। ভারতে প্রতি ৬ থেকে ১০ হাজার শিশুর মধ্যে একটি শিশু এসএমএ আক্রান্ত হয়ে জন্মায়। বাংলাদেশে এই বিরল এসএমএ রোগের জন্মের হার আরো বেশি হবে বলে চিকিত্সকরা আশঙ্কা করছেন। ২০১৭ সালে দেশে প্রথম এসএমএ রোগে আক্রান্ত শিশু শনাক্ত হয়। ধনী-গরিব সব পরিবারের শিশুরাই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। দেশে কোনো কোনো পরিবারের তিন জন শিশু এই বিরল রোগে আক্রান্ত। দেশে এ পর্যন্ত এসএমএ আক্রান্ত ৬০ থেকে ৭০টি শিশু শনাক্ত হয়েছে। দেশে যেহেতু রোগ শনাক্তের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, তাই বিদেশে নমুনা পাঠাতে হয়। অনেকে পরীক্ষা করানোর টাকা জোগাড় ও শনাক্ত করতে করতেই দুই বছর পার করে ফেলেন। এ সময়ের মধ্যে শিশুটি মারা যায়। এসএমএ টাইপ-১ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে রোগটি দ্রুত শনাক্ত করা গেলে ফিজিক্যাল থেরাপিসহ প্রাথমিক চিকিত্সা করা যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, দেশে স্বাস্থ্য খাতে কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। অনেক মেশিন ব্যবহার না হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জেনেটিক ল্যাব থাকলে এসএমএ রোগটি মায়ের গর্ভে থাকাকালীন শনাক্ত করা সম্ভব হতো। তখন অভিভাবকরা চিকিত্সার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারতো।

বিরল রোগ এসএমএ সম্পর্কে কাজ করছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের শিশু নিউরোলজিস্ট ডা. জোবায়দা পারভীন। তিনি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নারায়ণ সাহার নেতৃত্বে কাজ করছেন। আর এই কাজে সার্বিক তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক, প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বিন মোহাম্মদ ও যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম। ডা. জোবায়দা পারভীন বলেন, এসএমএ রোগটি দ্রুত শনাক্ত হওয়া প্রয়োজন। তাহলে রোগীর পরিবার চিকিত্সা সেবা পেতে আর্থিক প্রস্তুতি নিতে পারবে।

দেশে ইতিমধ্যে এক বছর বয়সি আরো এক শিশু এসএমএ আক্রান্ত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। তার নাম আবিয়াত রহমান। তার স্যাম্পল ভারতে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুকে জন্মের দুই বছরের মধ্যেই ২২ কোটি টাকার ইনজেকশন নিতে হয়। ইতিমধ্যে এক বছর সময় পার হয়েছে আবিয়াত রহমানের। আগামী এক বছরের মধ্যে ইনজেকশনটি নিতে না পারলে পিতা-মাতার চোখের সামনেই শিশুটির মৃত্যু হবে। আবিয়াত রহমানের পিতা একজন সরকারি কর্মকর্তা। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, টাকার অভাবে চোখের সামনেই সন্তানটি মারা যাবে, এটা মেনে নিতে পারছি না। ২২ কোটি টাকার ইনজেকশন দিতে পারলে আমার সন্তানকে বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু এতো টাকা আমার পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব না। এ জন্য আমি সবার সহযোগিতা চাই।

এদেশে আবিয়াত রহমানের মতো অনেক শিশু স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) নামক বিরল রোগে আক্রান্ত। কিন্তু অনেকে রোগটি সম্পর্কে জানেন না। এই বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছিল মানিকগঞ্জের শিশু রায়হান। গত ২৫ অক্টোবর ঐ শিশুর শরীরে ২২ কোটি টাকার ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালে। রায়হানের ঐ ইনজেকশন বিনা মূল্যে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের চিকিত্সকরা বলেন, বেশ কিছু শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছে। তাদের শরীরে রক্তসহ নানা বিষয়ে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এমনকি শিশুদের রক্তের নমুনাও সেখানে পাঠানো হয়। সেই রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রায়হানকে সিলেক্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিত্সকরা। যুক্তরাষ্ট্রে এ ওষুধটি বাজারজাত করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এ ওষুধ ক্রয় করে থাকে। যারা দরিদ্র রাষ্ট্র তাদের দেশে এ ওষুধ সীমিতসংখ্যক পাঠানোর জন্য লটারি পদ্ধতি বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই লটারিতেই বাংলাদেশে অত্যাধুনিক বিশেষায়িত হাসপাতাল নিউরো সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের শিশু নিউরোলজি বিভাগ অংশগ্রহণ করে। সেই লটারিতে রায়হান বিজয়ী হয়। রায়হানের শারীরিক অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে বলে জানালেন ডা. জোবায়দা শিরিন।

ইত্তেফাক/ইআ