খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃ তপশিলের নীতি উদার করে চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতি ছাড়ের সুযোগে ব্যাংকগুলোও ঋণ পুনঃ তপশিলের রেকর্ড গড়েছে। গত বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২ সালে মোট ২৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) পুনঃ তপশিল করা হয় ৫ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। বাকি ২৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকাই পুনঃ তপশিল করা হয়েছে জুলাই থেকে ডিসেম্বর এ ছয় মাসে।
এর আগে ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসে ব্যাংকগুলোর পুনঃ তপশিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত বছরের শেষ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল হয়েছে প্রায় তিন গুণ।
আগে খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিলের ক্ষমতা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে পুনঃ তপশিলের প্রস্তাব পাশ করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর পুনঃ তপশিলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করত। কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ে পুনঃ তপশিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনটি জারি হওয়ার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ঋণ পুনঃ তপশিলের সুযোগ পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ‘উদারতাকেই’ খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিলে উল্লম্ফনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্তের মধ্যেও খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টি রয়েছে। আবার ব্যাংকগুলো নিজেদের স্বার্থেই খেলাপি ঋণ কামানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। সব পক্ষের চাওয়া এক হয়ে যাওয়ায় বছরের শেষ ছয় মাসে পুনঃ তপশিলের পরিমাণ এতটা বেড়েছে।
ঋণ পুনঃ তপশিল বেড়ে যাওয়ায় ডিসেম্বরে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। তিন মাস পর একই বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। অর্থাৎ ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। তবে ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছর ব্যাংক খাতে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
২০১৯ সালে রেকর্ড ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করে ব্যাংকগুলো। তার আগে ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলো ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে ঐ বছর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার পথই বন্ধ হয়ে যায়। তার পরও ২০২০ সালে ব্যাংকগুলো ১৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করা হয়। ২০২১ সালেও ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন ধরনের ছাড় পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর পরও ঐ বছর ১২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করা হয়েছিল।
আগে খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিলের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ডাউন পেমেন্টের হার ২ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্যাংকের প্রভাবশালী বড় গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করে নিচ্ছেন। আবার গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বাছবিচার ছাড়াই পুনঃ তপশিল করা খেলাপি ঋণ পরে আবারো খেলাপির খাতায় উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃ তপশিল করে, এর মধ্যে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ আবারো খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালে পুনঃ তপশিল করা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১৮ শতাংশ।