বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

যৌতুকের মামলায় জামিন পেয়ে স্ত্রীকে ‘পিটিয়ে হত্যা’ 

  • বিচার দাবি পরিবারের
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৩, ২২:০৪

১৯ বছরের সংসার জীবন ফাতেমা নাসরিন ও তার স্বামী মির্জা সাখাওয়াত হোসেনের। তাদের ১৭ বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন সময়ে স্ত্রীর কাছে কোটি টাকা যৌতুক দাবি করে আসছিলেন স্বামী। সেই যৌতুক দাবির ঘটনায় প্রথমে পঞ্চগড়ে মামলাও হয়েছিলো। সেই মামলায় জামিনে বেরিয়ে রাজধানীতে স্ত্রী ফাতেমাকে কাঠের বাট দিয়ে মাথাসহ শরীরে বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আঘাত করে গুরুতর জখম করেন। সেই জখম নিয়ে রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে দশদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে শুক্রবার রাতে মারা গেলেন ফাতেমা (৪৫)। 

নিহত ফাতেমা হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের ভাতিজি। এ ঘটনায় নিহতের স্বামী প্রকৌশলী মির্জা সাখাওয়াত হোসেন (৪৯) গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

গত ৮ মার্চ বিকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় ফাতেমা নাসরিনকে যৌতুকের জন্য বটি ও মশলা বাটার কাঠের বাটলা দিয়ে মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত করে জখম করেন তার স্বামী। ওইদিনই নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১(খ) ধারায় করা মামলায় তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে 
মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। পরে তাকে আদালতের আদেশে কারাগারে পাঠানো হয়। আহত ফাতেমাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাতে তিনি মারা যান। এখন ওই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) তোফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভিকটিম মারা গেছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে স্বামীর নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছি। তদন্ত চলমান রয়েছে।

এদিকে ভাতিজি হত্যার ঘটনায় বিচার দাবি করেছেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের স্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহনাজ বাবলী। শনিবার সকালে হাসপাতালে মৃতদেহ দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ফাতেমা ভাতিজি হলেও আমরা তাকে মেয়ের মতই দেখতাম। মেয়েটা অনেক গুণবতী ছিল। ১৯ বছরের সংসারে মায়ার কারণে শত অত্যাচার সহ্য করেও নীরব ছিল। আমাদের কাছে কখনও স্বামীর অত্যাচারের কথা মুখ ফুটে বলতো না। নির্মম অত্যাচারে আমার মেয়েটা শেষ পর্যন্ত চলেই গেল। এখন তো আর তাকে ফিরে পাব না। তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের মেয়ে হত্যার বিচার চাই। এটাই আমাদের চাওয়া। এই হত্যার বিচার নিশ্চিতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।

এর আগে ভাতিজির মৃত্যুর খবর শুনে গতকাল সকালে হাসপাতালে ছুটে যান বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। এসময় উপস্থিত ছিলেন নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক, শেরে বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া। নিহতের ময়না তদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আজ ঠাকুরগাঁওয়ে দাফন করা হবে।

মামলার এজাহারে যা রয়েছে

ভিকটিমের বড় বোন আরজিনা বেগমের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে: বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে স্বামী ফাতেমার কাছে যৌতুক দাবি করে আসছিল স্বামী। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও এ অবস্থিত পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে এনে যেন তাকে এক কোটি টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু ওই পৈতৃক বাড়িতে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাগ আছে বিধায় তাকে টাকা এনে দেয়া সম্ভব নয়-এটা জানার পরই ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গত ১০ জানুয়ারি পঞ্চগড় সদর থানায় মামলা করেন স্ত্রী। সেই মামলায় জামিনে বেরিয়ে যৌতুকের জন্য পুনরায় স্ত্রীকে আবারও নির্যাতন করতে থাকেন। সেই নির্যাতনের এক পর্যায়ে গত ৮ মার্চ মোহাম্মদপুর হুমায়ুন রোডের বাসায় ফাতেমার মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। আত্মীয়-স্বজনরা খবর পেয়ে তাকে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, নিহতের মাথার খুলির পেছনের অংশের হাড় ভেঙে গিয়েছিলো। মস্তিষ্কে রক্ত জমাটবাঁধা ছিল।

প্রসঙ্গত, পঞ্চগড় গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মির্জা সাখাওয়াত। তার বাড়ি পঞ্চগড়ের মিঠাপুকুরে। বর্তমানে তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে রিজার্ভ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত। তিনি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই স্ত্রীর নাম জয়তুন বেগম (২০)। 

ইত্তেফাক/এএএম