শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

মুঘল সাম্রাজ্যের বেগম সাহেবা

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৩, ১৮:৩৫

শাহজাদী জাহানারা ছিলেন  সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাজ্ঞী  মুমতাজ মহলের জ্যেষ্ঠ কন্যা  (জন্ম ২ এপ্রিল ১৬১৪-১৬ সেপ্টেম্বর ১৬৮১)। ইতিহাসে তার পরিচয় বেগম সাহেবা। আলোকসামান্য রূপরাশির জন্য তার নামকরণ হয়েছিল ‘জাহান-আরা' বা জগতের অলঙ্কার। তার সৌজন্যবোধ ও শৈশবের শিক্ষা ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের জন্য বিশেষ সহায়ক ছিল।

মুমতাজমহল তার উপযুক্ত শিক্ষাবিধানের জন্য  ‘সতী উন্নিসা' নামের উচ্চ শিক্ষিতা পুণ্যবতী মহিলাকে নিযুক্ত করেছিলেন। শাহজাহান নন্দিনী অল্পকালের মধ্যে কুরআন পাঠ আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নূরজাহানের কাব্য প্রতিভা স্বরচিত ফারসি কবিতার বই দিওয়ানে মাকফিতে লিপিবদ্ধ, যা তার নিজের সুনিপুণ দক্ষতার পরিচয় দেয়।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘ডটারস অব দি সান' গ্রন্হের লেখক আরা মাখোতি বলেন, যখন আমি মুঘল সম্রাজ্ঞী ও শাহজাদীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করি তখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হই, শাহজাহানাবাদ বা আজকের পুরনো দিল্লী শহরের পরিকল্পনা ও মানচিত্র জাহানারার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল। সেসময়ের সবচেয়ে সুন্দর ও অভিজাত বাজার চাঁদনি চকও শাহজাদীর কাছে ঋণী। মোটকথা দিল্লিতে তার তুলনা ছিল না, দানশীলতা মহানুভবতা এবং জনপ্রিয়তা সবদিক থেকেই জাহানারা অদ্বিতীয়া ছিলেন। তার রূপ,সৌন্দর্য ও গুণের চর্চা হতো হেরেমের অভ্যন্তর এবং বাহির সবখানেই। 

জাহানারা বেগম দুইবার অগ্নি দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছিলেন। তার সত্ত্বেও জাহানারা বেগম অপরূপ সুন্দরী ও মেধাবী ছিলেন। সৌন্দর্যের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা, সঙ্গীতও রাজনীতিতে বেশ সুদক্ষ জাহানারা বেগম। ফার্সি ভাষায় তিনি দুটি বই লিখেছিলেন। ১৬৪৮ সালে তৈরি শহর শাহজাহানাবাদের ১৯ টির ভবনের ভিতর ৫টি ভবনই তার তৈরি নকশায় নির্মিত হয়। এই শাহজাহানবাদ বর্তমানে old দিল্লি নামে পরিচিত। এই নতুন শহর থেকে আসা সমস্ত অর্থ তার কাছেই আসতো।

জাহানারা বেগম মুঘল সাম্রাজ্যের সব থেকে সম্মানীয় নারী ছিলেন। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে গেলে,ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে তার পুত্রদের মাঝে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আওরঙ্গজেব কিংবা দাড়া শিকো,জাহানারা বেগমকে সবাই পছন্দ ও বিশ্বাস করতেন।

বলা হয়ে থাকে, জাহানারা বেগম ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী। তখনকার সময়ে বছরে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা আয় হতো।যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। সাম্রাজ্যের সাধারণ প্রজারাও তাকে খুব ভালোবাসতো, এমনকি তার জন্য তারা প্রাণ বিসর্জন দিতেও অনেক সময় সদা প্রস্তুত থাকত।

ঐতিহাসিক রানা সাভফি বলেন, জাহানারাকে আমরা শাহজাদী আখ্যায়িত করব না কিংবা এও বলব না যে, তিনি শাহানশাহ শাহজাহানের কন্যা বা আওরঙ্গজেব আলমগীরের সহোদরা ছিলেন, বরং তিনি নিজেই ছিলেন এক বিরাট ব্যক্তিত্বের মালিক। র পরিচয় তিনি ‘জাহানারা’।সাম্রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার পরামর্শ নেওয়া হতো। ‘সাহেবী’ নামে তার বাণিজ্যিক জাহাজ ছিল,এটি ডাচ ও ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে সমুদ্রপথে ব্যবস্হার মালামাল পরিবহন করত। তাছাড়া সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারেও বিভিন্ন দেশে মাল নিয়ে যাওয়া আসা করত শাহজাদী জাহানারার ‘সাহেবী’।

জাহানারা তার আদর্শ মা মুমতাজের অজস্র যত্নাদি ও স্বাস্থ্যকর পারিবারিক আবহাওয়ার বেষ্টনে বড় হয়ে উঠেছিলেন। জাহানারা মোগল ইতিহাসে কল্যাণময়ীর উজ্জ্বল প্রতীক। জগতের ইতিহাসে জাহানারার পিতৃভক্তি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে পরিকীর্তিত। 

জগতের ইতিহাসে জাহানারার পিতৃভক্তি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে পরিকীর্তিত। সর্বভোগত্যাগিনী,জাহানারা সেই সময় নিজের সর্বসুখ জলাঞ্জলি দিয়ে বন্দী পিতার আমরণ সেবা করে, ত্যাগের যে চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ছিলেন, তা থেকে বর্তমানে হয় তিনি গ্রীসরাজ দুহিতা পিতৃ সেবা তন্টিগনীর সঙ্গে একই আসনে বসার যোগ্য। বিখ্যাত ফরাসী কবি লেকৎ দ্যলিলে, মুঘল যুগের ভারতীয় নারীদের মধ্যে, একমাত্র তার বিষয়েই হিন্দু এন্টিগনী নামের এক প্রশংসাপূর্ণ কবিতা লিখেছেন। বর্তমানে পুরানো দিল্লীতে শেখ নিজাম্- উদ্দীন আউলিয়ার যে বিশাল সমাধি ভবন আছে, সেটার ভেতরে প্রাচীরবেষ্টিত এক স্বল্প আয়তনের জায়গায় জাহানারার সমাহিতা আছে। নিজের জীবনদ্দশায় তিনি নিজেই ওই সমাধি নির্মাণ করেছিলেন, ওই সমাধিভূমে সবুজ ঘাসের নিচে,নিরভিমানিনী জাহানারা অনন্ত নিদ্রায় শায়িতা রয়েছেন।

ইত্তেফাক/এআই