দেখতে দেখতে আবার বছর ঘুরে চলে এলো পবিত্র মাহে রমজান। মাহে রমজান এলেও বরকতের এই মাসে সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে। কারণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে লাগামহীনভাবে। এতে রোজাদারেরা কষ্ট পাচ্ছেন। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে এই সময়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে শত শত পণ্যের দামে ছাড় দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে, সেখানে বাংলাদেশে এর বিপরীত পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্তত ইসলামি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা যদি মজুতদারি থেকে বিরত থাকতে পারি, তাহলে রোজাদারগণ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।
ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে উত্সাহিত করেছে। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখেরাতে মজুতদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কুরআন মাজিদে বর্ণনা করা হয়েছে। মজুতদারি সম্পর্কে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, ‘যারা সোনা-রুপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সংবাদ দিন। সেদিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেওয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, এগুলো তো সেই সব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো।’ সুরা তাওবা :৩৪-৩৫
মজুতদার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কখনো কখনো পণ্যদ্রব্যের দাম তাদের ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেন। এ সম্পর্কে হজরত রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ ইবনে মাজা ও বায়হাকি। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুত করে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে কষ্ট দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পণ্য মজুত করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে লোক ৪০ দিন খাদ্যশস্য মজুত করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ মুসনাদে আহমাদ। এছাড়া এ প্রসঙ্গে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুত করে রাখে না।’ সহিহ মুসলিম।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুতকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুত করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে, তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুত করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে, সে ওমরের মেহমান। অতএব, সে তার আমদানির খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে।’ মুয়াত্তা ইমাম মালিক।
তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) তার খেলাফতকালে পণ্য মজুত নিষিদ্ধ করেছিলেন। চতুর্থ খলিফা হজরত আলি (রা.) মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার খেলাফাতকালে মজুত করা খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু মজুতদারি জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থি, তাই ইসলামে তা নিষিদ্ধ।
ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য বাজারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাহিদা ও জোগানের আলোকে নির্ধারিত হবে। তবে বাজার প্রক্রিয়াকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন ব্যাহত করতে না পারে, সেজন্য সরকার তদারকির ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারবে। ইসলামি আইনবিদদের মতে, সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। সরকার কর্তৃক ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরবিতে ‘তাসয়ির’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা ও উত্পাদক কোনো শ্রেণিরই ক্ষতি করা যাবে না, উভয় শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। ইসলামের এই ব্যবস্থা থেকে ধারণা নিয়ে সরকার পাইকারি ও খুচরা বাজারে দ্রব্যমূল্যের তালিকা ঝোলানো বাধ্যতামূলক করতে পারে। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে যাতে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো না হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.