রোজা হলো নিয়তের সঙ্গে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। যুগে যুগে বিভিন্ন নবি-রসুলের জামানায় এই রোজা ফরজ ছিল। উম্মতে মোহাম্মদির ওপর এরই ধারাবাহিকতায় রোজা ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত :১৮৩)।
প্রত্যেক নবি-রসুলের ওপর রোজা ফরজ থাকলেও এর সময়সীমা, মাস ও সংখ্যা নিয়ে কিছুটা তারতম্য ছিল। প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা ফরজ ছিল হজরত আদম (আ.)-এর ওপর। এই তিন দিনের রোজাকে বলা হয় আইয়ামে বিজের রোজা। এর পেছনের কারণ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ.)কে জান্নাতে একপ্রকার ফল খেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি আল্লাহর সেই আদেশ অমান্য করে উক্ত ফল খেয়ে ফেলেন, যার কারণে হজরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে আসতে বাধ্য হন। সে সময় তার দেহের রং কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। ফেরেশতারা হজরত আদম (আ.)-এর এই দুর্দশা দেখে কেঁদে ফেলেন এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন—হে আল্লাহ, আদম তোমার শ্রেষ্ঠ মাখলুক, তুমি তাকে জান্নাতে স্থান দিয়ে আমাদের দ্বারা সিজদাও করিয়েছিলে। মাত্র একটি ভুলের কারণে তার শরীরের রং কালো করে দিলে। তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রার্থনার জবাবে হজরত আদম (আ.)-এর কাছে ওহি পাঠালেন, ‘তুমি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা পালন করো।’ স্বয়ং নবিজি সফরে থাকা অবস্থায় এবং বাড়িতে বসে এই আইয়ামে বিজের রোজা রাখতেন।
হজরত নুহ (আ.)-এর সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। তিনি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন। হজরত নুহ (আ.)-এর যুগ থেকে শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত প্রতি মাসে তিনটি রোজার প্রচলন ছিল। অবশেষে আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের রোজা দিয়ে এই রোজাকে রহিত করে দিলেন। হজরত নুহ (আ.)-এর পরবর্তী সময়ে নবি ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তার সময়েও একই রোজার বিধান চালু ছিল। আশুরার দিন আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে দুশমনের হাত থেকে রক্ষা করলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রেখেছেন। মহানবি (স.) নিজেও এই দিনে রোজা রাখতেন এবং তার উম্মতদের এই দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই ৯ ও ১০ মহররম বা ১০ ও ১১ মহররম দুই দিন রোজা রাখতে হবে। তবে মহররমের ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখাই উত্তম।
হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন আল্লাহর নবি ও রসুল। তার সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। এই সময়কার রোজাই ছিল শ্রেষ্ঠ রোজা। হজরত রসল (স.) হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.)কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমি শ্রেষ্ঠ রোজা রাখবে। আর তা হলো দাউদ (আ.)-এর রোজা। এক দিন রোজা রাখবে। আর এক দিন রোজা রাখবে না।’ (মিশকাত)
হজরত ঈসা (আ.)-এর সময়েও রোজার প্রচলন ছিল, যার প্রমাণ করছে পবিত্র আল কুরআন, ‘তুমি খাও ও পান করো এবং চোখ জুড়াও। যখনই তুমি মানুষের কাউকে দেখতে পাবে তখন বলবে, আমি রহমান আল্লাহর নামে রোজার মানত করেছি। আমি আজ কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত :২৬)।
রসুলুল্লাহ (স.)-এর ওপর রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে, যা ছিল মহানবি (স.)-এর কিবলা পরিবর্তনের সময় ও হিজরতের অষ্টাদশ মাস। মহানবি (স.)-এর ওপর রোজা ফরজ হওয়ার পর পূর্ববর্তী নবি ও রসুলদের জামানার রোজার যে বিধান ছিল তার ফরজিয়াত রহিত হয়েছে। তবে পূর্ববর্তী এই রোজাগুলো সুন্নতি আমল হিসেবে এখনো কার্যকর রয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ইসলামি গবেষক