‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমরা লোহার চাংক, গাড়ির ভাঙা যন্ত্রাংশ, ইট, কাঠসহ যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছি তাই দিয়েই সন্ধ্যা থেকে ফার্মগেটে রাস্তা ব্যারিকেডের চেষ্টা করলাম। একটা গাছও কেটে ফেললাম। গাছটা বিদ্যুতের তারের ওপর পড়ে পুরো এলাকা বিদ্যুত্হীন হয়ে গেল। তখন ঘুটঘটে অন্ধকার। আগে থেকেই তেজগাঁও থানার দুই জন পুলিশ কনস্টেবল আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এভাবে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তার পাশেই আমরা অবস্থান নিলাম। মধ্যরাতে যখন আর্মির গাড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়, তখন শুধুই হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল।
কত গাড়ি ছিল সেটা গোনাও মুশকিল। আর্মির গাড়ির ঐ বহরে জিপ, ট্রাক এগুলোর সঙ্গে বুলডোজারও ছিল। আর্মির গাড়ি বহর যখন আমাদের ব্যারিকেডের সামনে এসে পৌঁছে তখন আমরা উচ্চ স্বরে জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিচ্ছিলাম। তখন ওরা একদিকে আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ছে, আরেক দিকে বুলডোজার দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছে। আমরা তাদের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকি। আমাদের কাছে কিছু হাতে তৈরি পেট্রোল বোমাও ছিল। সেগুলোও তাদের ওপর নিক্ষেপ করি। কিন্তু এতে তাদের কিছুই হয়নি। আর্মিদের গুলির মুখে ১০ মিনিট মতো আমরা টিকতে পেরেছিলাম। এরপর রাস্তা পরিষ্কার করে ওরা চলে যায়।’
ইত্তেফাকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের স্মতিচারণ করতে গিয়ে এভাবেই বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বর্তমানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। কলেজে ছাত্রলীগের কমিটিতে সদস্য ছিলেন। তবে তিনি রাজনীতি করতেন নিজের বাড়ি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায়। ছিলেন তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সভাপতি।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় মঞ্চের খুব কাছেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তিনি বলেন, আমারা আশা করেছিলাম বঙ্গবন্ধু ঐ সমাবেশ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? তখন তো আমরা রাজনীতি অতটা বুঝতে শিখিনি। কিন্তু তিনি যেটা বললেন তার প্রতিটি শব্দে ছিল দূরদর্শিতার ছাপ। তিনি প্রতিটি শব্দে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। খুব কাছ থেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখছিলাম। তিনি মঞ্চে উঠলেন, হাত নাড়ালেন। এ সময় বেশ কয়েকজন তার কাছে চিরকুট পাঠালেন। সেগুলো তিনি দেখলেন না। সবগুলো চিরকুট একত্রিত করে চশমা খুলে তার নিচে রাখলেন। এরপর বক্তৃতা শুরু করলেন। অন্য সময় তিনি আধাঘন্টা বক্তব্য দিলেও এদিন দিয়েছিলেন মাত্র ১৯ মিনিট। তার মধ্যেই সবকথা বলে দিয়েছিলেন। পরে আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জেনেছি, ‘বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে আসার আগে বঙ্গমাতা তাকে বলেছিলেন, আজ তুমি কারও কথা শুনবে না। তুমি যা বিবেক দিয়ে অনুধাবন করবে তাই বলবে। তোমার মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করবে’। বঙ্গবন্ধু ঐ দিন ঠিক সেই কাজটিই করেছিলেন।
রেসকোর্স ময়দানের কথা বলতে গিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, ঐদিন সভাস্থলে অনেকগুলো ড্রাম রাখা ছিল। এই ড্রামগুলো রাখা হয়েছিল মূলত অর্থ সংগ্রহের জন্য। যে যা পারে তা যেন ড্রামে দিয়ে যায়। এর মধ্যে একটা ড্রাম দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। সমাবেশ শেষে আমরা ড্রামে টাকা-পয়সার সঙ্গে পেয়েছিলাম নারীদের হাতের স্বর্ণের চুরি, গলার চেইন, কানের দুলও। অর্থাত্ নারীরা যারা এসেছিলেন তারা টাকা দিতে না পারলেও এগুলো খুলে দিয়ে গেছেন। তাদের সেই আবেগ আজও আমাকে নাড়া দেয়।
প্রথম প্রতিরোধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, আমরা ছাত্রনেতারা তখন প্রতিদিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের মাঠে যেতাম। সেখানে সিনিয়র নেতারা আমাদের নানা ধরনের পরামর্শ দিতেন। আমরা রাজনীতির খোঁজ খবরও পেতাম। ২৪ মার্চ সিনিয়রা আমাকে বললেন, আর্মিরা তো বের হবে মূল গেট (বর্তমানে জাহাঙ্গীর গেট) দিয়ে। ফলে ফার্মগেটে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। সেই প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। বলা হল, ফার্মগেটে তখন হাবিব ব্যাংক ছিল, ওইটার সামনে পরিখা খনন (এক ধরনের বাংকার) করতে হবে। আমি ফিরে এসে রেকি করে দেখলাম, আমরা পরিখা খনন করতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। কারণ বিজয় সরণির ওখানেই আর্মিরা তাঁবু গেড়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তখন চিন্তা করলাম কী করা যায়? ওখানে রাস্তার পাশে দুটো বড় কড়াই গাছ ছিল। আমরা ঐ গাছ কেটে ব্যারিকেডের চিন্তা করলাম। ২৫ মার্চ আমরা লোহার চাংক, গাড়ির ভাঙা যন্ত্রাংশ, ইট, কাঠসহ যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছি তা দিয়েই সন্ধ্যা থেকে রাস্তা ব্যারিকেডের চেষ্টা করলাম। আর্মিদের গুলির মুখে ১০ মিনিট মতো আমরা টিকতে পেরেছিলাম। এরপর রাস্তা পরিস্কার করে ওরা চলে যায়। ঐ রাতে আমরা কেউই বাড়িতে ফিরিনি। সারা রাত হেভিমেশিনগানের গুলির শব্দ, মাঝেমধ্যেই আকাশের দিকে আলোর ফুলকা দেখা যাচ্ছিল।
২৭ মার্চ পরিবারের সবাইকে নিয়ে পুরন ঢাকা হয়ে দোহার চলে যাই, বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, কয়েক দিন সেখানে থেকে ৭ এপ্রিল মানিকগঞ্জ গেলাম ক্যাপ্টেন হালিমের সঙ্গে দেখা করতে। তখন সেখানে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। দেখা হওয়ার পর তিনি ১২ এপ্রিল আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের আজিমনগর গ্রামে পাঠালেন। সেখানে আমি বৈঠক করলাম। ১২ জন সেদিন উপস্থিত ছিলেন। এরপর মানিকগঞ্জ থেকেই ক্যাপ্টেন হালিমের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে থাকি। এর মধ্যে আমাদের গোলাবারুদ কমে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন হালিম আমাকে দায়িত্ব দিলেন ভারতে গিয়ে খালেদ মোশারফের সঙ্গে দেখা করে তার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার। তিনি গোলাবারুদের ব্যবস্থা করবেন। আমি ভারতে গিয়ে খালেদ মোশারফের সঙ্গে দেখা করে গোলাবারুদের ব্যবস্থা করে ফিরে আসি। কয়েক দিন পর আমাদের চার জন মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে নৌকায় করে গোলাবারুদ পাঠালেন। পাঠানোর আগে তাদের বিস্ফোরক ব্যবহারের ট্রেনিংও দেওয়া হয়। তখন জুন মাস। নদীতে অতটা পানি আসেনি। তারা নৌকায় করে ফিরছে। মুন্সীগঞ্জের তালতলা এলাকায় পৌঁছালে তীর থেকে আর্মিরা নৌকা ভেড়ানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু তীরে ভেড়ালেই তো বিপদ। মাঝি দ্রুত নৌকা পাটক্ষেতের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় আর্মিরা ব্রাশফায়ার করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন আলাউদ্দিন। নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আলাউদ্দিন তখন নিজের জামা খুলে মুখে গুঁজে নিয়েছিলেন। যাতে তার আত্মচিত্কারে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে না পারে। ওরা ফিরে এসে যখন ঐ ঘটনা আমাকে বলল, আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। দেশের জন্য তার কত বড় আত্মত্যাগ। আরেক বার একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে এসে বললেন তার একটা অ্যান্টি পারসোনাল মাইন দরকার। কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, তার রাজাকার বাবাকে তিনি মারতে চান।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টের হালিমের অধীনে সরাসরি অনেকগুলো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার যুদ্ধের এলাকা ছিল মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ ঢাকা সদরের ২২ থানা এলাকা। ক্যাপ্টেন হালিম তাকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তাকে নারিশা থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত (নারিশা ইউনিয়ন, মুকসুদপুর ইউনিয়ন, শ্রীনগর থানার পুরোটা) অপারেশনের দায়িত্ব দেন। ক্যাপ্টেন হালিম নিজ হাতে তাকে একটা বন্দুক তুলে দিয়েছিলেন। যদিও এর মধ্যে কিছুদিন তিনি ভারতে অবস্থান করে অস্ত্রের ট্রেনিং নেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ের হরিরামপুরে পাকিস্তানি আর্মির বেতার স্থাপনায় আক্রমণ চালাতে গিয়ে শহিদ হন মাহফুজ (বীরপ্রতীক)। যুদ্ধের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, তখন কয়েকটি মজার ঘটনাও ঘটেছে। দোহার শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে আমরা নারিশায় পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘেরাও করি। আক্রমণের মুখে দেখা গেল ইপিআরের এক সিপাহি এলএমজি চালাচ্ছেন না। কাছে গিয়ে দেখি তিনি ভয়ে কাঁপছেন। প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, আমি তো অটোমেটিক ভুইল্লা গেছি। ঐ দিন আমাদের অবস্থান টের পেয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা মুহূর্তেই পালিয়ে যায়। আরেকটি ঘটনা মনে করে তিনি বলছিলেন, একদিন আমরা নৌকায় করে ঝিটকা ব্রিজের নিচ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন রাজাকাররা আমাদের নৌকা দেখে প্রশ্ন করে কে যায়? মাঝি প্রথমবার নিরুত্তর থাকেন। রাজাকাররা আবার প্রশ্ন করলে মাঝি উত্তর দেয় ‘বিপদ’। রাজাকাররা আবারও হাঁক দেয় কে যায়? মাঝি এবার জোরে চিত্কার করে বলেন ‘বিপদ’। এই কথা শোনা মাত্রই রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনারা দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। আসলে মাঝির নাম ছিল ‘বিপদ’।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা যুদ্ধ করতে করতে ১৪ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ পৌঁছাই। ১৬ ডিসেম্বর আমরা সেখানেই ছিলাম। সেখান থেকেই শুনলাম পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কথা। সে সময়ে কী যে আনন্দ, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার ১০-১২ দিন পর আব্দুর রাজ্জাক চাচা বললেন—চলো যাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে চাচার সঙ্গে গেলাম। যুদ্ধের আগে তিন-চার বার ছাত্র নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। নামও বলেছি। এদিন দেখা হওয়ার পর আমি বললাম, নেতা আমাকে চিনতে পেরেছেন? জবাবে তিনি বললেন, তোমার নাম আমার ছেলের নামে। চিনব না কেন? তখন মনে হল, কী প্রখর স্মৃতিশক্তি তার। কতদিন আগে নাম বলেছি, আজও মনে রেখেছেন।
সাক্ষাত্কারের ভিডিও দেখতে স্ক্যান করুন কিউআর কোডটি